–সেটা কানুর বাবার কাছে বিক্রী করে দিয়েছি। অত বড় বাক্স কি হবে? তা ছাড়া সঙ্গে টেনে টেনে নিয়ে বেড়ানোও মুশকিল।
হঠাৎ হিরন্ময়ী ঝপ ক’রে মেঝেতে বসে পড়ল–কর্তৃত্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সুরে বললে–না, আপনি যেতে পারবেন না। দেখি দিকি কেমন যান?
আমার হাসি পেল ওর রকম দেখে। খুব আনন্দও হল–একটা অদ্ভুত ধরনের আনন্দ হল। বললাম–তোমার তাতে কি, আমি যাই আর না-যাই? তুমি তো আর এতদিন উঁকি মেরেও দেখতে আস নি হিরণ, তুমি আমার পাঠশালা পর্যন্ত যাওয়া ছেড়েছ।
–ইস! তাই বৈ কি?
—তুমি ভেবে দেখ তাই কি না। উড়িয়ে দিলে চলবে না হিরণ, আমি যাবই ঠিক করেছি, তুমি আমায় আটকাতে পারবে না। কারুর জন্যে কারুর আটকায় না–এ তুমি নিজেই আমায় একদিন বলেছিলে।
হিরন্ময়ী বালিকাসুলভ হাসিতে ঘর ভরিয়ে ফেলে বললে–ওই! কথা যদি একবার শুরু করে দিলেন তো কি আর আপনার মুখের বিরাম আছে? কারুর জন্যে কারুর আটকায় না, হেন না তেন না–মাগো–কথার ঝুড়ি একেবারে!।
–সে যাই হোক, আমি যাবই।
—কখখনো না। উঃ, বললেই হল যাব!
আমি চুপ করে রইলাম–ছেলেমানুষের সঙ্গে তর্ক করে আর লাভ কি?
দেখি যে বিকেলে পাঠশালায় হিরন্ময়ী বইখাতা নিয়ে হাজির হয়েছে। সে এসে সব ছেলেমেয়েকে বলে দিলে আমার পাঠশালা উঠবে না, আমি কোথাও যাব না, সবাই যেন ঠিকমত আসে। এমন সুরে বললে যে সে যেন আমার দণ্ডমুণ্ডের মালিক। বললে–এই হাঁদু, মাস্টার মশায় তোমায় বলেছিলেন না ধারাপাত আনতে–কেন আন নি ধারাপাত? এই সোমবারের হাট থেকে আনতে বলে দেবে। বুঝলে?
হাঁদু বোকার মত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বললে–মাস্টারমশাই যে সোমবারে চলে যাবেন এখান থেকে?
হিরন্ময়ী তাকে এক তাড়া দিয়ে বললে–কে বলেছে চলে যাবেন? মেরে হাড় ভেঙে দেব ছোঁড়ার! যা যা বলছি তা শোন। বাঁদর কোথাকার–
আমি বললাম–কেন ওকে মিথ্যে বকছ হিরণ, ছেলেমানুষকে–ওর দোষ কি, আমি যাবই, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।
হিরন্ময়ী ঝঙ্কার দিয়ে বললে–আচ্ছা আচ্ছা হবে। যাবেন তো যাবেন।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা অনেকদিন পরে ও রান্নাঘরে এসে ঢুকল। বললে–গুড়ের ভাঁড়টা কই!
–সেটা তিনকড়িদের দিয়ে দিইছি। দু-দিনের মত খানিকটা গুড় ওই বাটিতে রেখেছি–দুটো দিন ওতেই চলে যাবে।
হিরন্ময়ী অন্য দিনের মত বসল না দাঁড়িয়ে রইল। একবার বাইরে যাবার সময় ও সরে দরজার কপাটের আর দেওয়ালের মধ্যের যে জায়গাটুকু, সেখানটাতে দেখি জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে গেলাম–ওখানে না, ওখানে না,–কাপড়ে কালিটালি লেগে যাবে কি না–বার হয়ে এস–
ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখি ওর ডাগর চোখ দুটি জলে ভরে টল টল করছে।
হিরন্ময়ীর চোখে জল! অবাক, এ দৃশ্য তো কখনও দেখি নি! ও জল-ভরা ধরা-গলায় বললে–আপনি বলুন, যাবেন না মাস্টার মশায়। আমি তখন পাঠশালায় বলতে পারলাম না ওদের সামনে। ওরা হাসবে তাহলে। আর কেউ নয়–আর সবাই আমায় ভয় করে, কেবল ওই মন্টুটা বড় দুষ্টু!
তারপর আমার দিকে চোখের জল আর হাসি মিশানো এক অপূর্ব দৃষ্টিতে চেয়ে বললে–যাবেন না, কেমন?
হিরন্ময়ী এই প্রথম দুর্বলতা প্রকাশ করলে–এর আগে কখনও দেখি নি। ছেলেমানুষ, ও কথা তো তেমন জানে না, কিন্তু ওর ডাগর সজল চোখের মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি ওর ভাষার দৈন্য ঘুচিয়ে দিয়ে এমন কিছু প্রকাশ করলে–এক জাহাজ কথাতে তা প্রকাশ করা যেত না।
আমার মনে অনুতাপ হল–কেন ওকে মিথ্যে কাঁদালাম সন্ধ্যাবেলাটিতে?
জীবনের এই-সব মুহূর্তেই না মানুষে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করে? ব্রাউনিঙের ‘পলিন’ কবিতার সেই সর্বহারা লোকটির মত আমার মনও ভরে উঠল— I believe in God and Truth and Love!…
ওর হাতটি ধরে দরজার কপাটের ফাঁক থেকে বার করে এনে আস্তে আস্তে পিঁড়ির ওপর বসিয়ে দিয়ে বললাম–ওখানে সন্ধ্যাবেলা দাঁড়াতে নেই। বিছেটিছে বেরুতে পারে-এখানে বোস। রুটিগুলো বেলে দাও দিকি, লক্ষ্মী মেয়ে। আমি যাব না–বলছ তুমি যখন, তখন আর যাব না। চোখের জল ফেলতে আছে অবেলায়? ছিঃ–
তার পরই রুটি তৈরি করতে বসে যে হিরন্ময়ী সেই হিরন্ময়ী–সেই মুখরা বালিকা, যে সকল কথা এমন কর্তৃত্বের সুরে বলে যেন ওর কথা না মেনে চললে ও ভয়ঙ্কর একটা কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করবে, সেটা আবার খুব কৌতুকপ্রদ এবং ভেবে দেখলে করুণ বলেই মনে হয়, যখন বুঝতে পারা যাচ্ছে যে মুখের বুলিটুকু ছাড়া ওর হুকুমের পেছনে ওর কোন জোর খাটাবার নেই–নিতান্ত অসহায় ও নিরুপায়।
প্রেম আসে এই সব সামান্য তুচ্ছ খুঁটিনাটি সূত্র ধরে। বড় বড় ঘটনাকে এড়ানো সহজ, কিন্তু এই সব ছোট জিনিস প্রাণে গেঁথে থাকে–ফলুই মাছের সরু চুল-চুল কাঁটার মত। গায়ের জোরে সে কাঁটা তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে গেলে, বিপদের সম্ভাবনা বাড়ে বৈ কমে না।
পুরুষমানুষ প্রেমের ব্যাপারে আত্মরক্ষা করে চলতে পারে না যেটা অনেক সময়ে মেয়েরা পারে। যেখানে যা হবার নয়, পাবার নয়, সেখানেও তারা বোকার মত ধরা দিয়ে বসে থাকে–এবং নাকাল তার জন্যে যথেষ্ট হয়। কিন্তু পুরুষমানুষই আবার বেগতিক বুঝলে যত সত্বর হাবুডুবু খেতে খেতেও সাঁতরে তীরের কাছে আসতে পারে–মেয়েরা গভীর জলে একবার গিয়ে পড়লে অত সহজে নিজেদের সামলে নিতে পারে না।
তবুও আমি হিরন্ময়ীকে দূরে রাখবার চেষ্টাই করলাম।