হিরণ্ময়ী বোধ হয় একটু সঙ্কোচের সঙ্গেই এসেছিল, আমি ওর আসাটা কি চোখে দেখি–এ নিয়ে। আমার কথা শুনে হাজার হোক নিতান্ত ছেলেমানুষ তো–ও যেন ভরসা পেল। ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা পিঁড়ি পেতে বসল। আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে–কি সেই শিখিয়ে দিলেন, ‘নয় পরিত্যাগ-প্রণালী’ না কি? সব ভুলে গিয়েছি–হি হি–
দেখলাম ওর বিয়ে হয় নি।–ওকে আর কোন কথা বলি নি অবিশ্যি তা নিয়ে। দেনা পাওনার ব্যাপার নিয়ে সে-সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছে–দু-চার দিন পরে অপরের মুখে শুনলাম। আবার হিরন্ময়ী আমার পাঠশালাতে নিত্য আসে যায়–সন্ধ্যাবেলাতেও রোজ আসে–ঝড় হোক বৃষ্টি হোক, তার সন্ধ্যায় আসা কামাই যাবে না। কেন তার মা এবার তাকে বকেন না–সেকথা আমি জানি নে–তবে বকেন না যে, এটা আমি জানি।
বরং একদিন হিরন্ময়ী বললে–আজ আলো জ্বেলে একটা বই পড়ছি, মা বললে আজ যে তুই তোর মাস্টারের কাছে গেলিনে বড়? তাই এলুম মাস্টার মশায়।
আমি বললাম–তা বেশ তো, গল্পের বই পড়লেই পারতে। মা না বলে দিলে তো আজ আসতে না?
কথাটা বলতে গিয়ে নিজের অলক্ষিতে একটা অভিমানের সুর বার হয়ে গেল– হিরন্ময়ী সেটা বুঝতে পেরেছে অমনি। এমন বুদ্ধিমতী মেয়ে এইটুকু বয়সে! বললে– নিন, আর রাগ করে না। ভেবে দেখুন, আপনি না আমায় এখানে এলে তাড়িয়ে দিতেন আগে আগে?
দুঃখিত ভাবে বললাম–ছিঃ ও-কথা বলো না হিরণ, তাড়িয়ে আবার তোমায় দিয়েছি কবে? ও-কথাতে আমার মনে কষ্ট দেওয়া হয়।
হিরন্ময়ী মুখে কাপড় দিয়ে খিল খিল করে উচ্ছ্বসিত ছেলেমানুষি হাসির বন্যা এনে দিলে। ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগল–না–না দেন নি? বটে? একদিন–সেই– তাড়ালেন না! আজ আবার বলা হচ্ছে—-। পরে আমার সুরের নকল করতে চেষ্টা করে—‘ওতে আমার মনে কষ্ট দেওয়া হয়’–কি মানুষ আপনি!—হি-হি-হি-হি–
আমি মুগ্ধদৃষ্টিতে ওর হাসিতে উদ্ভাসিত সুকুমার লাবণ্যভরা মুখের দিকে চেয়ে রইলাম–চোখ আর ফেরাতে পারি নে–কি অপূর্ব হাসি! কি অপূর্ব চোখমুখের শ্রী!
যখন চোখ নামিয়ে নিলাম তখন সে আমার বেলুনটা তুলে নিয়ে রুটি বেলতে বসে গিয়েছে। সেদিন ও যখন চলে যায়, ঝোঁকের মাথায় অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই ওকে আবার বললাম–এ রকম আর এস না, হিরণ! না, সত্যি বলছি তুমি আর এস না।
মনকে খুব দৃঢ় করে নিয়ে কথাটা বলে ফেলেই ওর মুখের দিকে চেয়ে আমার বুকের মধ্যে যেন একটা তীক্ষ্ণ তীর খচ করে বিঁধলো। দেখলাম ও বুঝতে পারে নি আমি কেন একথা বলছি–কি বোধ হয় দোষ করে ফেলেছে ভেবে ওর মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে উদ্বেগ ও ভয়ে।
আমার মুখের দিকে একটুখানি চেয়ে রইল–যদি মুখের ভাবে কারণ কিছু বুঝতে পারে। না বুঝতে পেরে যাবার সময় দেখলাম শুষ্ক বিবর্ণ মুখে বললে–আমায় তাড়িয়ে দিলেন তো, এই দেখুন–তাড়ালেন কি না।
দুঃখে আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। নিমগাছটার তলা দিয়ে ও ওই যাচ্ছে, এখনও বেশী দূর যায় নি, ডেকে দুটো মিষ্টি কথা বলব? ছেলেমানুষকে একটু সান্ত্বনা দেব?
ডাকলুম শেষটা না পেরে।–শোনো ও হিরণ-শোনো–
ও দাঁড়াল না–শুনেও শুনল না। হন হন করে হেঁটে বাড়ি চলে গেল। পরদিন খুব সকালে উঠে বারান্দাতে বসে ব্রাউনিঙের A Soul’s Tragedy পড়ছি–হিরণ এসে দাঁড়িয়ে বললে–কি খাচ্ছেন?
–এস এস হিরণ। কাল তোমাকে ডাকলাম রাত্রে, এলে না কেন? তুমি বড় একগুঁয়ে মেয়ে–একবার শোনা উচিত ছিল না কি বলছি?
মুখরা বালিকা এবার নিজমূর্তি ধরলে। বললে–আমি কি কুকুর নাকি, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবেন, আবার তু করে ডাকলেই ছুটে আসব? আপনি বুঝি মনে ভাবেন আমার শরীরে ঘেন্না নেই, অপমান নেই–না? আমি বলতে এলাম সকালবেলা যে আপনার পাঠশালায় আমি পড়তে আসব না।—মা অনেক দিন আগেই বারণ করেছিল–তবুও আসতাম, তাদের কথা না শুনে। কিন্তু যখন আপনি কুকুর-শেয়ালের মত দূর করে তাড়িয়ে—
ওর চোখে জল ছাপিয়ে এসেছে–অথচ কি তেজ ও দৰ্পের সঙ্গে কথাগুলো সে বললে! আমি বাধা দিয়ে বললাম–আমায় ভুল বুঝো না, ছিঃ হিরণ–আচ্ছা, চেঁচিও না বেশী, কেউ শুনলে কি ভাববে। আমরা কথা শোন–রাগ করে না ছিঃ!
হিরণ দাঁড়াল না এক মুহূর্তও। অতটুকু মেয়ের রাগ দেখে যেমন কৌতুক হল, মনে তেমনই অত্যন্ত কষ্টও হল। কেন মিথ্যে ওর মনে কষ্ট দিয়েছি কাল? আহা, বেচারী বড় দুঃখ ও আঘাত পেয়েছে। আমার জ্ঞান আর হবে কবে? ছেলেমানুষকে ও-কথাটা ওভাবে বলা আমার আদৌ উচিত হয় নি।
মন অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল–ভাবলাম, এ গ্রামের পাঠশালা তুলে দিয়ে অন্যত্র যাবই। এদিকে হিরন্ময়ীও আর আমার পাঠশালাতে আসে না। মাসের বাকি আটটা দিন পড়িয়ে নিয়ে পাঠশালা তুলে দেব ঠিক করে ফেললাম। সবাইকে বলেও রাখলাম কথাটা। আগে থেকে যাতে সবাই অন্য ব্যবস্থা করে নিতে পারে।
যাবার দু-দিন আগে জিনিসপত্র গোছাচ্ছি–হঠাৎ হিরণয়ী নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে এসে কখন দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলে ওর দিকে চাইতেই হেসে ফেললে। বললে–আপনি নাকি চলে যাবেন এখান থেকে?
আমি বললাম–যাবই তো। তার পর, এত দিন পরে কি মনে করে?
হিরন্ময়ী তার অভ্যাসমত আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বললে–কবে যাবেন?
—বুধবার বিকেলে গাড়ি ঠিক করা আছে, চাকদাতে গিয়ে উঠবো।
হিরন্ময়ী একবার ঘরের চারিধারে চেয়ে দেখল। বললে–আপনার সে বড় বাক্সটা কই?