হিরন্ময়ী হেসে বললে–এই! তা কি এমন বলেছি আমি? তা যখন আপনি বলছেন দোষ হয়েছে বলাতে, তখন দোষ নিশ্চয়ই হয়েছে।
–কেন তুমি বললে ওরকম? তোমার দুঃখিত হওয়া উচিত ওকথা বলার জন্যে, তা জান?
হিরণয়ী বললে–হাঁ, হয়েছি। হল তো? এখন নিন।
তারপর যখন ওর অঙ্ক দেখছি, তখন হঠাৎ আমার মুখের দিকে কেমন একটা বুঝতে না পারার দৃষ্টিতে চেয়ে বললে–উঃ, আপনার এত রাগ?…আগে তো কখনও রাগ দেখি নি এরকম?…তখনও সে আমার মুখের দিকে সেইরকম দৃষ্টিতে চেয়ে কি যেন বুঝবার চেষ্টা করছে। ওর রকম-সকম দেখে আমি হাসি চাপতে পারলাম না–সঙ্গে সঙ্গে সেই মুহূর্তে হিরন্ময়ীকে নতুন চোখে দেখলাম। দেখলাম হিরন্ময়ী অত্যন্ত লাবণ্যময়ী, ওর চোখ দুটি অত্যন্ত ডাগর, টানা-টানা জোড়া ভুরু দুটি কালো সরু রেখার মত, কপালের গড়ন ভারী সুন্দর, চাঁচা, ছোট, অর্ধচন্দ্রাকৃতি। মাথায় একরাশ ঘন কালো চুল।
ও তখনও আমার দিকে সেই ভাবেই চেয়ে আছে। এক মিনিটের ব্যাপারও নয় সবটা মিলে।
পরদিন থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, হিরন্ময়ী আমার কাছ থেকে তত দূরে আর বসে না–আর না ডাকলেও কাছে এসে দাঁড়ায়।
একদিন আমায় বললে–জানেন মাস্টার মশায়, আমার সব দল এরা–আমায় এরা ভয় করে।
অবাক হয়ে বললুম–কারা?
হাত দিয়ে পাঠশালার সব ছাত্রছাত্রীদের দেখিয়ে দিয়ে বললে-–এরা। আমার কথা না শুনে কেউ চলতে পারে না।
–ভয় করে কেন?
—এমনি করে। আমি যা বলব ওদের শুনতেই হবে।
পাঠশালার সকলেরই ওপর সে হুকুম ও প্রভুত্ব চালায়। এটা এতদিন আমার চোখে পড়ে নি–সেদিন থেকে সেটা লক্ষ্য করলাম। তবে পেনো যে সেদিন ওর হাত আঁচড়ে দিয়েছিল সে আলাদা কথা। দেশের রাজার বিরুদ্ধেও তো তাঁর প্রজারা বিদ্রোহী হয়।
রোজ রাত্রে বাসায় এসে সন্ধ্যাবেলা পরোটা গড়ি। দু-একদিন পরে সন্ধ্যাবেলা ময়দা মাখছি একা রান্নাঘরে বসে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার বেশী নয়, একটা হ্যারিকেন-লণ্ঠন জ্বলছে ঘরে। কার পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে হিরন্ময়ী। শশব্যস্তে উঠে বিস্মিত মুখে বললাম–হিরণ! এস, এস, কি মনে করে?
হিরন্ময়ীর একটা স্বভাব গোড়া থেকে লক্ষ্য করেছি, কখনই প্রশ্নের ঠিক জবাবটি দেবে না। আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললে–ময়দা মাখেন বুঝি নিজে রোজ? এই বুঝি ময়দা মাখা হচ্ছে?
আমি বিপন্ন হয়ে পড়লুম–চোদ্দ বছরের মেয়েকে পাড়াগাঁয়ে বড়ই বলে। আমার কাছে এ রকম অবস্থায় আসাটা কি ঠিক হল ওর? এসব জায়গার গতিক আমি জানি তো।
বললাম–তুমি যাও হিরণ, পড় গে।
হিরন্ময়ী হেসে বললে–তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেন? আমি যাব না–এই বসলাম।
বেজায় একগুঁয়ে মেয়ে, আমি তো জানি ওকে। বললে–একটা অঙ্ক কষে দেবেন? না-থাক, একটা গল্প বলুন না!…ও, আপনি বুঝি ময়দা মাখবেন এখন! সরুন, সরুন দিকি। আমি মেখে বেলে দিচ্ছি। কি হবে–রুটি, না লুচি?..আপনি এই পিঁড়িটাতে বসে শুধু গল্প করুন।
সেই থেকে হিরন্ময়ীর রোজ সন্ধ্যাবেলা আমাকে সাহায্য করতে আসা চাই-ই। মৃদু প্রদীপের আলোতে হাসি-হাসি মুখে সে তার খাতাখানা খুলে নামে অঙ্ক কষে–কাজে কিন্তু সে আমার রুটি-পরোটা তৈরী করে দেয়। কিছুতেই আমার বারণ শোনে না–ওর সঙ্গে পারব না বলে আমিও কিছু আর বলিনে। ওর মায়ের বারণও শোনে না, একদিন কথাটা আমার কানে গেল।
শুনলাম একদিন মাকে বলছে ওদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে–কেন, যাই তাই কি? আমি অঙ্ক কষতে যাই। বেশ করি–যাও।
হিরন্ময়ীকে বললাম–শোন হিরণ, আমার এখানে সন্ধ্যাবেলা আর এস না, যখন তোমার মা বকেন। মার কথাটা অন্তত তোমার মানা উচিত। বুঝলে?
পরদিন হিরন্ময়ী সত্যিই আর এল না। আমার সন্ধ্যাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। ওর না আসাতে, সেদিন প্রথম লক্ষ্য করলাম। সাত-আট দিন কেটে গেল–হিরন্ময়ী পাঠশালাতে রোজই আসে। তাকে জিজ্ঞাসা করি না অবিশ্যি কেন সে সন্ধ্যাবেলা আসে না।
একদিন সে পাঠশালাতেও এল না। দু-তিন দিন পরে জিজ্ঞেস করে জানলাম সে মামার বাড়ি গিয়েছে তার মায়ের সঙ্গে।
দেখে আশ্চর্য হলাম যে আমার পাঠশালা আর সে পাঠশালা নেই–আমার সন্ধ্যাও আর কাটে না। হিরণের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে ওর মামার বাড়ি থেকে, মেয়ে দেখাতে নিয়ে গিয়েছে–বরপক্ষ ওখানে মেয়েকে আশীর্বাদ করবে।
মানুষের মন কি অদ্ভুত ধরনের বিচিত্র! হঠাৎ কথাটা শুনেই মনে হল ও গাঁয়ের পাঠশালা উঠিয়ে দেব, অন্যত্র চেষ্টা দেখতে হবে। কেন, যখন প্রথম পাঠশালা খুলেছিলাম এ গাঁয়ে, তখন তো হিরণের অপেক্ষায় এখানে আসি নি, তবে সে থাকলো বা গেল– আমার তাতে কি আসে যায়?
মাসখানেক কেটে গিয়েছে। আমি কলের মত কাজ করে যাই, একদিন সামান্য একটু বাদলা মত হয়েছে–পাঠশালার ছুটি দিয়ে সকাল-সকাল রান্না সেরে নেব বলে রান্নাঘরে ঢুকেছি, বেলা তখনও আছে। এমন সময় দোরের কাছে দেখি হিরন্ময়ী এসে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়েছে। আমি বিস্ময়মিশ্রিত খুশীর সুরে বলে উঠলাম–এস, এস হিরণ,-কখন এলে তুমি? বসো।
হিরন্ময়ী বললে–কেমন আছেন আপনি? তারপর সে এগিয়ে এসে সলজ্জ আড়ষ্টতার সঙ্গে ঝপ করে আমার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে আবার সোজা হয়ে দোরের কাছে দাঁড়ালো।
আমি এত খুশী হয়েছি তখন, ওকে কি বলবো ভেবে পাইনে যেন। বললাম–বসো হিরণ, দাঁড়িয়ে কেন?