মালতী তাড়াতাড়ি খুকীকে আমার কোল থেকে তুলে নিলে। তার পর আমার রুক্ষ চুল ও উদভ্রান্ত চেহারার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। পরক্ষণেই সে দাওয়া থেকে নেমে এসে বললে–আপনি আসুন, উঠে এসে বসুন।
আখড়ায় আর যেন কেউ নেই। উদ্ধবদাসকেও আর দেখলাম না। শুধু মালতী আর আমি। ও ঠিক সেই রকমই আছে–সেই হাসি, সেই মুখ, সেই ঘাড় বাঁকিয়ে কথা বলার ভঙ্গি। হেসে বললে–তারপর?
আমি বললাম–তারপর আর কি? এই এলাম।
—এতদিন কোথায় ছিলেন?
—নানা দেশে। তারপর দাদা মারা গেলেন, আমার ওপরে ওদের সংসারের ভার।
—উঃ, কি নিষ্ঠুর আপনি! তারপর সে বললে–আপনি বসুন, খুকীর সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। একবার নীরদা-দিদিকে ডাকি।
আমি বললাম–আমি কিন্তু এখনই যাব মালতী। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ফেলে রেখে এসেছি পরের বাড়িতে। আমাকে যেতেই হবে।
মালতী আশ্চর্য হয়ে বললে–আজই?
আমি বললাম–আমার কাজ আমি শেষ করেছি, এখন তুমি যা করবে কর খুকীকে নিয়ে। আমি থেকে কি করব? আমি যাই।
মালতী স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল–আমায় নিয়ে যান তবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম–সে কি মালতী? তুমি যাবে আমার সঙ্গে? তোমার এই আখড়া?
মালতীর সঙ্গে যেদিন ছাড়াছাড়ি হয়েছিল, সেদিনটি যেমন ও চোখ নামিয়ে কথা বলেছিল–ঠিক তেমনই ভঙ্গিতে চোখ মাটির দিকে রেখে স্পষ্ট ও দৃঢ় সুরে বললে– আপনি আমায় নিয়ে চলুন সঙ্গে যেখানে আপনি যাবেন। এবার আপনাকে একলা যেতে দেব না।
একচল্লিশ দিনে জ্বর ছেড়ে গেল। সেরে উঠলে বৌদিদি একদিন বললেন–জ্বরের ঘোরে মালতী মালতী বলে ডাকতে কাকে, মালতী কে ঠাকুরপো?
আমি বললাম–ও একটি মেয়ে। বাদ দাও ও-কথা। রোজ বলতাম? কত দিন বলেছি?
এই অসুখ-বিসুখে মাসীমার দেওয়া সেই একশো টাকা তো গেলই, বৌদির গায়ের সামান্য যা দু-একখানা গহনা ছিল তা-ও গেল। নতুন চাকুরিটাও সঙ্গে সঙ্গে গেল।
এখান থেকে তিন ক্রোশ দূরে কামালপুর বলে একটা গ্রাম আছে। নিতান্ত পাড়াগাঁ এবং জঙ্গলে ভরা। সেখানকার দু-একজন জানাশোনা ভদ্রলোকের পরামর্শে সেখানে একটা পাঠশালা খুললাম। বৌদিদিদের আপাতত কালীগঞ্জে রেখে আমি চলে গেলাম কামালপুরে। একটা বাড়ির বাইরের ঘরে বাসা নিলাম–বাড়ির মালিক চাকুরির স্থানে থাকেন, বাড়িটাতে অনেকদিন কেউ ছিল না। বাড়ির পিছনে একটা আম-কাঁঠালের বাগান।
পাঠশালায় অনেক ছেলে জুটল–কতকগুলি ছোট মেয়েও এল। যা আয় হয়, সংসার একরকমে চলে যায়।
সময় বড় মনের দাগ মুছে দেবার মন্ত্র জানে। আবার নতুন মন, নতুন উৎসাহ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে জীবনের একটা নতুন অধ্যায় কি রকমে শুরু হ’ল তাই এখানে বলব।
পাঠশালা খুলবার পরে প্রায় দু-বছর কেটে গিয়েছে। ভাদ্র মাস। বেশ শরতের রোদ ফুটেছে। বর্ষার মেঘ আকাশে আর দেখা যায় না। একদিন আমি পাঠশালায় গিয়েছি, একটা ছোট মেয়ে বলছে–মাস্টার মশায়, পেনো হিরণদিদির হাত আঁচড়ে কামড়ে নিয়েছে, ওই দেখুন ওর হাতে রক্ত পড়ছে।
যে মেয়েটির হাত আঁচড়ে নিয়েছে তার নাম হিরণ্ময়ী, বয়স হবে বছর চৌদ্দ, পাঠশালার কাছেই ওদের বাড়ি–কিন্তু মেয়েটি আমার পাঠশালায় ভর্তি হয়েছে বেশী দিন নয়। ওর বাবার নাম কালীনাথ গাঙ্গুলী, তিনি কোথাকার আবাদের নায়েব, সেইখানেই থাকেন, বাড়িতে খুব কমই আসেন।
আমি লক্ষ্য করেছি এই মেয়েটি সকলের চেয়ে সজীব, বুদ্ধিমতী, অত্যন্ত চঞ্চলা। সকলের চেয়ে সে বয়সে বড়, সকলের চেয়ে সভ্য ও শৌখীন। কিন্তু তার একটা দোষ, কেমন একটু উদ্ধত স্বভাবের মেয়ে।
একদিন কি একটা অঙ্ক ওকে দিলাম, সবাইকে দিলাম। ওর অঙ্কটা ভুল গেল। বললাম–তুমি অঙ্কটা ভুল করলে হিরণ?
অঙ্কটা ভুল গিয়েছে শুনে বোধ হয় ওর রাগ হল–আর দেখেছি সব সময়, অপর কারোর সামনে বকুনি খেলে ক্ষেপে ওঠে। খুব সম্ভব সেই জন্যই ও রাগের সুরে বললে–কোথায় ভুল? কিসের ভুল বলে দিন না?
আমি বললাম–কাছে এস, অতদূর থেকে কি দেখিয়ে দেওয়া যায়?
আমি দেখে আসছি যে কদিন ও এসেছে, আমার কাছ থেকে দূরে বসে।
ও উদ্ধতভাবে বললে–কেন, ওখান থেকেই বলুন না? আপনার কাছে কেন যাব?
আমার মনে হ’ল ও বড় মেয়ে বলে আমার কাছে আসতে বোধ হয় সঙ্কোচ অনুভব করে। কিন্তু তার জন্যে ওরকম উদ্ধত সুর কেন? বললাম–কাছে এসে আঁক দেখে নিতে দোষ আছে কিছু?
ও বললে–সে-সব কথার কি দরকার আছে? আপনি দিন অঙ্ক ওখান থেকেই বুঝিয়ে।
রাগে ও বিরক্তিতে আমার মন ভরে উঠল। আচ্ছা মেয়ে তো? মাস্টারদের সঙ্গে কথাবার্তার এই কি ধরন? আর আমায় যখন এত অবিশ্বাস তখন আমার স্কুলে না এলেই তো হয়? সেদিন আমি ওর সঙ্গে আর কোন কথাই বললাম না। পরদিনও তাই, স্কুলে এল, নিজে বসে বসে কি লিখলে বই দেখে, একটা কথাও কইলাম না। ছুটির কিছু আগে আমায় বললে–আমার ইংরেজিটা একবার ধরুন না?
আমি ওর পড়াটা নিয়ে তারপর শান্তভাবে বললাম–হিরণ, তোমার বাড়িতে বলো, আমি তোমাকে পড়াতে পারব না। অন্য ব্যবস্থা করতে বলো কাল থেকে।
হিরন্ময়ীর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, বললে–কেন?
আমি বললাম–না–তুমি বড় মেয়ে, এখানে তোমার সুবিধে হবে না।
ও বললে–রাগ করেছেন নাকি? কি করেছি আমি?
আমি বললাম–কাল তোমার ও-কথাটা কি আমায় বলা উচিত হয়েছে, হিরণ? কি বলে তুমি বললে, আপনার কাছে কেন যাব?…ওখান থেকেই বলুন না? তুমি আমার কাছে তবে পড়তে এসেছ কেন?