মা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। সীতা গিয়ে বললে–মা, দাদাকে আগে ভাত দিও না, আমরা সবাই বাবার সঙ্গে খাবো।
সীতার কথা শেষ হতে না হতে দাদা গিয়ে রান্নাঘরে হাজির। দাদা খিদে মোটে সহ্য করতে পারে না–তাই আমাদের সকলের আগে মা তাকে খেতে দিতেন। এদিকে আমাদের ক’ ভাই-বোনের মধ্যে বাবা সকলের চেয়ে ভালবাসতেন দাদাকে ও সীতাকে। দাদাকে খাওয়ার সময়ে কাছে বসে না খেতে দেখলে তিনি কেমন একটু নিরাশ হতেন, যেন অনেকক্ষণ ধরে যেটা চাইছিলেন সেটা হ’ল না।
সীতা বললে–দাদা তুমি খেও না, বাবা আজ সকলকে নিয়ে খাবেন। বাবা নাইচেন, এক্ষুনি আমরা খেতে বসবো–
দাদা কড়া থেকে মাকে একটুকরো মাংস তুলে দিতে বললে এবং গরম টুকরোটা মুখে পুরে দিয়ে আবার তখুনি তাড়াতাড়ি বার করে ফেলে বার-দুই ফুঁ দিয়ে আবার মুখে পুরে নাচতে নাচতে চলে গেল। দাদাকে আমরা সবাই খুব ভালবাসি, দাদা বয়সে সকলের চেয়ে বড় হলেও এখনো সকলের চেয়ে ছেলেমানুষ। ও সকলের আগে খাবে, সকলের আগে ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুরিয়ে কথা বললে বুঝবে না, অন্ধকারে একলা ঘরে শুতে পারবে না–ওর বয়স যদিও বছর চোদ্দ হ’ল, কিন্তু এখনও আমাদের চেয়ে ও ছেলেমানুষ, প্রথম সন্তান ব’লে বাপ-মায়ের বেশী আদর ওরই ওপর।
আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম। বাবা সীতাকে একপাশে ও দাদাকে আর একপাশে নিয়ে খেতে বসেছেন। মাংসের বাটি থেকে বাবা চর্বি বেছে বেছে ফেলে দিতেই সীতা বললে–বাবা আমি খাবো—
দাদা বললে–তুই সব খাসনে, আমাকে দু’খানা দে সীতা–
বাবা অত চর্বি ওদের খেতে দিলেন না। ওদের এক এক টুকরো দিয়ে বাকি টুকরোগুলো বেড়ালদের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমায় বললেন–জিতু, গায়ের মাপটা দিস তো তোর, ওবেলা সায়েবের দর্জি আসবে, তার কাছে তোর জামা করতে দেবো–
সীতা বললে–আমার আর একটা জামা কার বাবা—
তবে তুইও দিস গায়ের মাপটা,–ওই সঙ্গেই দিস–
মা বললেন–তার দরকার কি, তুমি তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিও না। আমি সব দেখেশুনে দেবো–আরও করবার জিনিস রয়েচে–নিতুর মোটে দুটো জামা, ওর ওভারকোটটা পুরনো হয়ে ছিঁড়ে গিয়েছে–যেমন শীত পড়েছে এবার, ওর একটা ওভারকোট করে দাও–
বিকেলে মেমেরা মাকে পড়াতে এল।
মাইল দুই দূরে মিশনারীদের একটা আড্ডা আছে। আমি একবার মেমসাহেবের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে খোসালডি চা-বাগানে যে রাস্তাটা পাহাড়ের ঢালু বেয়ে নেমেছে–তারই ধারে ওদের বাংলো। অনেকগুলো লাল টালির ছোট বড় ঘর, বাঁশের জাফরির বেড়ায় ঘেরা কম্পাউন্ড, এই শীতকালে অজস্র ডালিয়া ফোটে, বড় বড় ম্যাগনোলিয়া গাছ। আমাদের বাগানে ও বড় সাহেবের বাংলোতে ম্যাগনোলিয়া গাছ আছে।
এরা মাকে পড়ায়, সীতাকেও পড়ায়। মিস নর্টন দিনাজপুরে ছিল, বেশ বাংলা বলতে পারে। নানা ধরনের ছবিওয়ালা কার্ড, লাল সবুজ রঙের ছোট ছোট ছাপানো কাগজ, তাতে অনেক মজার গল্প থাকে। দাদার পড়াশুনোয় তত ঝোঁক নেই, আমি ও সীতা পড়ি। একবার একখানা বই দিয়েছিল–একটা গল্পের বই—‘সুবর্ণবণিক পুত্র’। এ কথায় আমি বুঝেছিলাম বণিকপুত্র সোনা দিয়ে গড়া অর্থাৎ সোনার মত ভালো। পাপের পথ থেকে উক্ত বণিকপুত্র কি করে ফিরে এসে খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করলে, তারই গল্প। অনেক কথা বুঝতে পারতাম না, কিন্তু বইখানা এমন ভাল লাগতো!…
মেম আসতো দু-জন। একজনের বয়স বেশী–মায়ের চেয়েও বেশী। আর একজনের বয়স খুব কম। অল্পবয়সী মেমটির নাম মিস নর্টন–একে আমার খুব ভাল লাগতো– নীল চোখ, সোনালী চুল, আমার কাছে মিস নর্টনের মুখ এত সুন্দর লাগতো, বার বার ওর মুখের দিকে চাইতে ইচ্ছে করত, কিন্তু কেমন লজ্জা হ’ত–ভালো করে চাইতে পারতাম না–অনেক সময় সে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে থাকবার সময় লুকিয়ে এক চমক দেখে নিতাম। তখনি ভয় হ’ত হয়ত সীতা দেখছে–সীতা হয়ত এ নিয়ে ঠাট্টা করবে। ওরা আসতো বুধবারে ও শনিবারে। সপ্তাহের অন্যদিনগুলো যেন কাটতে চাইত না, দিন গুনতাম কবে বুধবার আসবে, কবে শনিবার হবে। মিস নর্টনের মত সুন্দরী মেয়ে আমি কখনো দেখিনি—-আমার এই এগারো-বারো বছরের জীবনে।
কিন্তু মাঝে মাঝে এমনি হতাশ হ’তে হ’ত! দিন গুনে গুনে বুধবার এল, কিন্তু প্রৌঢ়া মেমটি হয়তো সেদিন এল একা, সঙ্গে মিস নর্টন নেই–সারা দিনটা বিস্বাদ হয়ে যেতো, মিস নর্টনের ওপর মনে মনে অভিমান হ’ত, অথচ কেন আজ মিস নর্টন এল না সে কথা কাউকে জিজ্ঞেস করতে লজ্জা হত।
মেমেরা এক-একদিন আমাদের ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে শেখাতো। মা তখন থাকতেন না। আমি, সীতা ও দাদা চোখ বুজতাম–মিস নর্টন ও তার সঙ্গিনী চোখ বুজতো। ‘হে আমাদের স্বর্গস্থ পিতা সদাপ্রভু’–সবাই একসঙ্গে গম্ভীর সুরে আরম্ভ করলুম। হঠাৎ চোখ চেয়ে দেখতুম সবাই চোখ বুজে আছে, কেবল সীতা চোখ খুলে একবার জিব বার করেই আমার দিকে চেয়ে একটু দুষ্টুমির হাসি হাসলে–পরক্ষণেই আবার প্রার্থনায় যোগ দিলে।
সীতা ঐ রকম, ও কিছু মানে না, নিজের খেয়াল-খুশীতে থাকে, যাকে পছন্দ করবে তাকে খুবই পছন্দ করবে, আবার যাকে দেখতে পারবে না তার কিছুই ভাল দেখবে না। ওর সাহসও খুব, দাদা যা করতে সাহস করে না, এমন কি আমিও যা অনেক সময় করতে ইতস্তত করি–ও তা নির্বিচারে করে। আমাদের বাংলো থেকে খানিকটা দূরে বনের মধ্যে একটা দেবস্থান আছে–পাহাড়ীদের ঠাকুর থাকে। একটা বড় সরল গাছের তলায় কতকগুলো পাথর–ওরা সেখানে মুরগী বলি দেয়, ঢাক বাজায়। সবাই বলে ওখানে ভূত আছে, জায়গাটা যেমন অন্ধকার তেমনি নির্জন–একবার দাদা তর্ক তুলে বললে আমরা কখনোই ওখানে একা যেতে পারবো না। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সীতা বাংলোর বার হয়ে চলে গেল একাই–কোনো উত্তর না দিয়েই ছুট দিলে পাহাড়ীদের সেই নির্জন ঠাকুরতলার দিকে …ওই রকম ওর মেজাজ …