ওদের জাঙ্কের কেউ কোনোরকম বাধা দিলে না–দেওয়া সম্ভবও ছিল না। দস্যুরা দলে ভারি, তা ছাড়া অত বন্দুক এ নৌকোয় ছিল না। সকলের মুখ বেঁধে ওরা নৌকোয় যা কিছু ছিল, সব কেড়ে নিয়ে নিজেদের জাঙ্কে ওঠালে। বিমল ও সুরেশ্বরের কাছে যা ছিল, সব গেল। আ-চীন প্রদত্ত এক-শো ডলারের নোটখানা পর্যন্ত–কারণ সেখানা ভাঙাবার দরকার না হওয়ায় ওদের বাক্সেই ছিল।
চীন সমুদ্রের বোম্বেটের উপদ্রব সম্বন্ধে বিমল ও সুরেশ্বর অনেক কথা শুনেছিল। সিঙ্গাপুরে আরও শুনেছিল যে জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন হওয়ায় সমস্ত হংকং-এর নিকটবর্তী সমুদ্রে জড়ো হচ্ছে–এদিকে সুতরাং বোম্বেটেদের মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত।
চীন ও মালয় জলদস্যুরা শুধু লুঠপাট করেই ছেড়ে দেয় না–যাত্রীদের প্রাণনষ্টও করে। কারণ এরা বেঁচে ফিরে গিয়ে অত্যাচারের সংবাদ সিঙ্গাপুর বা হংকং-এ প্রচার করলেই চীন ও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট কড়াকড়ি পাহারা বসাবে সমুদ্রে। মরা মানুষ কোনো কথা বলে না–এ প্রাচীন নীতি অনেক ক্ষেত্রেই বড়ো কাজ দেয়।
দেখা গেল বর্তমান দস্যুরা এ নীতি ভালোভাবেই জানে। কারণ জিনিসপত্র ওদের জাঙ্কে রেখে এসে ওরা আবার ফিরে এল বিমলদের নৌকোয়–যেখানে পাটাতনের ওপর মাঝিমল্লার দল সারি সারি মুখ ও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
বিমল ছিল নিজের কামরায়। সুরেশ্বর কোথায় বিমল তা জানে না। একজন বদমাইশকে ছোরা হাতে ওর কামরায় ঢুকতে দেখে বিমল চমকে উঠল।
লোকটা সম্ভবত চীনাম্যান। বয়স আন্দাজ ত্রিশ, সার্কাসের পালোয়ানের মতো জোয়ান নীল ইজের আর একটি বুক কাটা কোর্তা গায়ে। মুখখানা দেখতে খুব কুশ্রী নয়, কিন্তু কঠিন ও নিষ্ঠুর। ওর হাতে অস্ত্রখানা বিমল লক্ষ করে দেখলে ঠিক ছোরা নয়, মালয় উপদ্বীপে যাকে ক্রিস বলে তাই। যেমনি চকচকে তেমনি সেখানা ক্ষুরধার বলে মনে হল!
সে ক্রিসখানা বিমলের সামনে উঁচু করে তুলে ধরে দেখিয়ে বললে–আমি তোমাকে একটু বিরক্ত করতে এসেছি, কিছু মনে কোরো না।
বিমলের মুখ বাঁধা, সে কী কথা বলবে?
লোকটা পকেট থেকে একটা চামড়ার থলি বার করে সেটার মুখ খুলে বিমলের চোখের সামনে মেলে ধরলে। শুকনো আমচুরের মতো কতকগুলি কী জিনিস তার মধ্যে রয়েছে! বিমল অবাক হয়ে ভাবছে এ জিনিসগুলি কী, বা তাকে এগুলি দেখানোর সার্থকতাই বা কী–এমন সময় লোকটা একটা শুকনো আমচুর বার করে ওর নাকের সামনে ধরে বলে– চিনতে পারলে না কী জিনিস?
বিমল এতক্ষণে জিনিসটা চিনতে পারলে এবং চিনে ভয়ে ও বিস্ময়ে শিউরে উঠল। সেটা একটা কাটা শুকনো কান, মানুষের কান! লোকটা হা হা করে নিষ্ঠুর বিদ্রুপের হাসি হেসে বললে-বুঝেছ এবার? হাঁ, ওটা আমার একটা বাতিক–মানুষের কান সংগ্রহ করা। তোমাকেও তোমার কান দুটির জন্যে একটুখানি কষ্ট দেব। আশা করি মনে কিছু করবে না। এসো, একটু এগিয়ে এসো দেখি।
বিমল নিরুপায়, মুখ দিয়ে একটা কথা বার করবার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই তার। এক মুহূর্তে তার মনে হল হয়তো সুরেশ্বরের সমানই অবস্থা ঘটেছে, এতক্ষণে তারও অশেষ দুর্দশা হচ্ছে এই পীতবর্ণ বর্বরদের হাতে।
বুদ্ধদেবের ধর্মকে এরা বেশ আয়ত্ত করেছে বটে!
লোকটা সময়ের মূল্য বোঝে, কারণ কথা শেষ করেই বুদ্ধশিষ্যের এই বিচিত্র নমুনাটি চকচকে ক্রিসখানা হাতে করে এগিয়ে এল–বিমলের সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল–মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট আর্তনাদ বার হতে চেয়েও হল না, সে প্রাণপণে দুই চোখ বুজলে।
তীক্ষ্ণ ক্রিসের স্পর্শ খুব ঠাণ্ডা–কতটা ঠাণ্ডা, খু-উব ঠাণ্ডা কি? ক্রিসের স্পর্শ এল না, এল তার পরিবর্তে দূর থেকে একটা অস্পষ্ট গম্ভীর আওয়াজ–প্রস্তরময় কূলে সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রবল বেগে আছড়ে পড়ার শব্দের মতো গম্ভীর।
কতকগুলি ব্যস্ত মানুষের সম্মিলিত দ্রুত পদশব্দ বিমলের কানে গেল–বিস্মিত বিমল চোখ খুলে চেয়ে দেখলে লোকটা ছুটে কামরার বাইরে চলে গেল–চারিদিকে একটি সাড়া শোরগোল, কাঠের পাটাতনের ওপর অনেকগুলি পলায়নপর মানুষের দ্রুত পায়ের শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে।
কী ব্যাপার? এ আবার কী নতুন কান্ড?
পরক্ষণেই বিমলের মনে হল তাদের জাঙ্কখানা একটা প্রকান্ড দুলুনি খেয়ে একেবারে কাত হয়ে পড়বার উপক্রম করেই পরমুহূর্তে ঢেউয়ের তালে যেন আকাশে ঠেলে উঠল–নোঙরের শিকলে কড় কড় শব্দে টান ধরল–মজবুত শিকল না হলে সেই হেঁচকাটানে ছিঁড়ে যেত নিশ্চয়ই। একটু পরে বিমলদের নৌকোর একজন জোয়ান মাঝি ওর কামরায় ঢুকে হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিলে।
তখনও পাশে কোথায় খুব হইচই হচ্ছে।
বিমল বললে–ব্যাপার কী বলো তো?আমার বন্ধুটি কোথায়?
মাঝি বললে–সে ভালোই আছে।
বলেই সে বাইরে চলে গেল। বেশি কথা বলে না এদেশের লোক।
বিমল তাড়াতাড়ি কামরার বাইরে এসে দেখলে সামনে এক অদ্ভুত ব্যাপার। নবাগত বোম্বেটে জাঙ্কখানা কঠিন প্রস্তরময় ডাঙায় ধাক্কা খেয়ে জখম হয়েছে। আর অল্প দূরেই সমুদ্রবক্ষে এমন একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলে যা জীবনে কখনো দেখেনি।
আকাশ থেকে কালো মোটা থামের মতো একটা জিনিস নেমে সমুদ্রের জলে মিশে গিয়েছে –সে জিনিসটা আবার চলনশীল–হ্যাঁলকা রবারের বেলুন বা ফানুসের মতো অত বড়ো কালো মোটা থামটা বায়ুর গতির সঙ্গে ধীরে উত্তর থেকে দক্ষিণে ভেসে চলেছে।