সন্ধ্যাবেলায় ওরা এসে জোহোর স্ট্রিটের পার্কের ব্যাণ্ড-স্ট্যাণ্ডের কোণে আ-চীন ও সুব্বা রাওয়ের সাক্ষাৎ পেলে। ওদের সব কথাবার্তা শুনে আ-চীন বললে–তাহলে আপনাদের রওনা হতে হবে কাল রাত্রে। ক-দিনে আপনাদের হোটেলের বিল যা হয়েছে তা কাল বিকালেই চুকিয়ে দিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে আপনারা এইখানে অপেক্ষা করবেন। বাকি ব্যবস্থা আমি করব। আর এই নিন–
কথা শেষ করে বিমলের হাতে একখানা কাগজ গুঁজে দিয়ে আ-চীন ও সুব্বা রাও চলে গেলেন।
বিমল খুলে দেখলে কাগজখানা এক-শো ডলারের নোট।
পরদিন সকাল থেকে ওরা বাড়িতে চিঠিপত্র লেখা, কিছু কিছু জিনিসপত্র কেনা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত রইল। বৈকালে নির্দেশমতো আবার ব্যাণ্ড-স্ট্যাণ্ডের কোণে এসে দাঁড়াল।
একটু পরেই আ-চীন এলেন। বিমলকে জিজ্ঞেস করলেন—
আপনাদের জিনিসপত্র?
হোটেলেই আছে।
হোটেলে রেখে ভালো করেননি। একখানা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে গিয়ে জিনিসপত্র তুলে এখানে নিয়ে আসুন। আমি এখানেই থাকি। পার্কের কোণে ছোটো রাস্তাটার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে হর্ন দিতে বলবেন। আপনাদের আর কিছু লাগবে?
না, ধন্যবাদ। যা দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট।
আধঘণ্টার মধ্যেই বিমল ও সুরেশ্বর ট্যাক্সিতে ফিরে পার্কের কোণে দাঁড়িয়ে হর্ন দিতে লাগল।
আ-চীন এসে ওদের গাড়িতে উঠে মালয় ভাষায় ড্রাইভারকে কী বললেন। সে ট্যাক্সি বড়ো পোস্ট অফিসের সামনে এসে দাঁড় করালো।
বিমল বললে–এখানে কী হবে?
বিমলের কথা শেষ হতে-না-হতে ওদের ট্যাক্সির পাশে একখানা নীল রংয়ের হুইপেট গাড়ি এসে দাঁড়াল। স্টিয়ারিং ধরে আছে একজন চীনা ড্রাইভার।
আ-চীন বললেন–উঠুন পাশের গাড়িতে।
পরে তাঁর ইঙ্গিত মতো দু-জন ড্রাইভার মিলে জিনিসপত্র সব নতুন গাড়িখানায় তুলে দিলে। গাড়ি যখন তিরবেগে সিঙ্গাপুরের অজানা বড়ো রাস্তা বেয়ে চলেছে, তখন বিমল বললে–অত সদরে দাঁড়িয়ে ও ব্যবস্থা করলেন কেন? কেউ যদি টের পেয়ে থাকে?
আ-চীন বললেন–কেউ করবে না জানি বলেই ওই ব্যবস্থা। এ সময়ে চীনা ডাক নিতে রোজ কনসুলেট অফিসের লোক ওখানে আসবে সকলেই জানে। আমার পরনে কনসুলেট ইউনিফর্ম, আমি লুকিয়ে কোনো কাজ করতে গেলেই সন্দেহের চোখে লোকে দেখবে। সদরে কেউ কিছু হঠাৎ মনে করবে না।
একটু পরেই সমুদ্র চোখে পড়ল–নারিকেল শ্রেণির আড়ালে। শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে একটা নিভৃত স্থানে এসে গাড়ি একটা বাংলোর কম্পাউণ্ডের মধ্যে ঢুকল। পাশেই নীল সমুদ্র।
আ-চীন বললেন–এখানে নামতে হবে। বাংলোর একটা ঘরে ওদের বসিয়ে আ-চীন বললেন–আমি যাই। এখানে নিশ্চিন্ত মনে থাকুন। কোনো ভয় নেই। যথাসময়ে আপনাদের খাবার দেওয়া হবে। বাকি ব্যবস্থা সব রাত্রে।
তিনি চলে গেলেন। একটু পরে জনৈক চীনা ভৃত্য ছোটো ছোটো পেয়ালায় সবুজ চা ও কুমড়োর বিচির কেক নিয়ে ওদের সামনে রাখলে।
বিমল বললে–এ আবার কী চিজ বাবা? ইঁদুর ভাজা-টাজা নয় তো?
সুরেশ্বর বললে–ইঁদুর নয়, কুমড়োর বিচি, তা স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে ইঁদুর খাওয়া অভ্যেস করতে হবে, নইলে হরিমটর খেয়ে থাকতে হবে চীন দেশে।
কিন্তু কেকগুলি ওদের মন্দ লাগল না। চা পানের পরে ওরা বাংলোর চারিধারে একটু ঘুরে বেড়ালে। সিঙ্গাপুরের উপকণ্ঠে নির্জন স্থানে সমুদ্রতীরে বাংলোটি অবস্থিত। সমুদ্রের দিকে এক সারি ঝাউ অপরাহ্রে বাতাসে সোঁ সোঁ করছিল। দূরে সমুদ্র বক্ষে অস্তসূর্যের আভা পড়ে কী সুন্দর দেখাচ্ছে।
সুরেশ্বর ভাবছিল হুগলি জেলার তাদের সেই গ্রাম, তাদের পুরোনো বাড়ি–বাপ-মায়ের কথা। জীর্ণ, সান-বাঁধানো পুকুরের ঘাটের পৈঠা বেয়ে মা পুকুরে গা ধুতে নামছেন এতক্ষণ।
জীবনের কীসব অদ্ভুত পরিবর্তনও ঘটে! তিন মাস মাত্র আগে সেও এমনি সন্ধ্যায় ওই গ্রামের খালের ধারটিতে একা পায়চারি করে বেড়াত ও কীভাবে কোথায় গেলে চাকরি
পাওয়া যায় সেই ভাবনাতে ব্যস্ত থাকত। আর আজ কোথায় কতদূরে এসে পড়েছে।
বিমল মুগ্ধ হয়েছিল এই সুদূরপ্রসারী শ্যামল সমুদ্র-বেলার সান্ধ্যশোভার দৃশ্যে। সে ভাবছিল কবি ও ঔপন্যাসিকদের পক্ষে এমন বাংলো তো স্বর্গ–মাথার ওপরকার নীল আকাশ–এই সবুজ ঝাউয়ের সারি–ওই সমুদ্রবক্ষের ছোটো ছোটো পাহাড়–সত্যিই স্বর্গ–
গভীর রাত্রে আ-চীন এসে ওদের ওঠালেন। একখানা মোটরে আধ মাইল আন্দাজ গিয়ে সমুদ্রতীরের একটা নির্জন স্থানে ওরা জিনিসপত্র সমেত ছোটো একটা জালি বোটে উঠল। দূরে বন্দরের আলোর সারি দেখা যাচ্ছে–অন্ধকার রাত্রি, নির্জন সমুদ্র বক্ষ। কিছুদূরে একটা চীনা জাঙ্ক অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল–জালিবোট গিয়ে জাঙ্কের গায়ে লাগল।
দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওরা জাঙ্কে উঠল।
পাটাতনের নীচে একটা ছোটো কামরা ওদের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। কামরাতে একটা চীনা মাদুর বিছানো, বেতের বালিশ, চীনা লণ্ঠন, রঙিন গালার পুতুল, কাঁচকড়ার ফুলের টবে নার্সিসাস ফুল গাছ–এমনকী ছোটো খাঁচাসমেত একটি ক্যানারি পাখি।
আ-চীন বললেন–কামরা আপনাদের পছন্দ হয়েছে তো?
সুরেশ্বর বললে–সুন্দর সাজানো কামরা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আ-চীন গম্ভীরভাবে বললেন–ধন্যবাদ আপনাদের। আমাদের বিপন্ন দেশকে দয়া করে আপনারা সাহায্য করবার জন্যে এত কষ্ট স্বীকার করে অজানা ভবিষ্যতের দিকে চলেছেন। ভগবান যুদ্ধের দেশের লোক আপনারা–সবসময়েই আপনারা আমাদের নমস্য। ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদ আপনাদের ওপর বর্ষিত হোক।