একটি গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে এ্যালিস ক্লান্তভাবে বসল।
বিমল বললে–মিনিরা কোথায়?
মন্দিরের মধ্যে ঢুকেছে। এখানে বোসো। কেমন সুন্দর লাল মাছ খেলা করছে দেখো। আমি কী ভাবছি বিমল জান, এমন পবিত্র মন্দির, এমন সুন্দর শান্তি, এই প্রাচীন পাইন গাছের সারি–সব জাপানি বোমায় একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। যুদ্ধের এই পরিণাম, প্রাচীন দিনের শান্তি ও সৌন্দর্যকে চুরমার করে বর্বরতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
এ্যালিস, আর কতদিন চীনে থাকবে?
যতদিন যুদ্ধ শেষ না হয়, যতদিন একজন আহত চীন সৈনিকও হাসপাতালে পড়ে থাকে। ততদিন ড্যাডি লি তাঁর সাহায্যকারিণী মেয়ের দরকার অনুভব করেন।
এ্যালিস বিমলের দিকে চেয়ে বললে–কিন্তু বিমল ততদিন তোমাকেও তো থাকতে হবে –তোমাকে যেতে দেব না।
পাইন গাছের ওদিকে নিকটেই প্রোফেসর লি-র প্রাণখোলা হাসি ও কথাবার্তার আওয়াজ শোনা গেল।
এ্যালিস বললে–ওরা এদিকেই আসছে।
এ্যালিসের ভুল হয়েছিল, মিনি আর সুরেশ্বর এল না–এলেন প্রোফেসর লি। এই বয়সেও তাঁর চোখের অমন অদ্ভুত দীপ্তি যদি না থাকত, তবে তাঁকে জনৈক বৃদ্ধ চীনা রিকশাওয়ালা বলে ভুল করা অসম্ভব হয় না–এমনি সাদাসিধে তাঁর পরিচ্ছদ।
প্রোফেসর লি বললেন–হ্যাং-কাউ শহরে এসে আমার গরিব গ্রামবাসীরা আশ্রয় পেয়ে বেঁচেছে। কিন্তু গভর্নমেন্টের তৈরি মাটির নীচের ঘরে লুকিয়ে থাকলে আমার চলবে না এ্যালিস, আমি কালই এখান থেকে গ্রামে চলে যাব।
এ্যালিস বললে, কেন?
দক্ষিণ চীনে সর্বত্র ভীষণ দুর্ভিক্ষ। লোক না খেয়ে মরছে, তার সাথে বোমা আছে। মড়ক লেগেছে। আমার এখানে বসে থাকলে চলে?
আমি আবেদন পাঠিয়েছি আমেরিকায় মার্কিন রেডক্রস সোসাইটির মধ্যস্থতায়। তারাই আপেল পাঠিয়েছিল এদের খাওয়াতে। যতদূর জানা গিয়েছে, ওরা কিছু অর্থ মঞ্জুর করেছে! টাকাটা শিগগির আসবে।
এ্যালিস বললে–ড্যাডি, আমার একটি প্রস্তাব শুনবেন? আমার মাসিমা নিঃসন্তান বিধবা, অনেক টাকার মালিক। আমায় তিনি উইল করে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন, টাকাটা আমি চাইলেই পাব। সেই টাকা আপনাকে দিচ্ছি–হ্যাং-কাউ শহরে দুঃস্থ বালক-বালিকাদের জন্যে একটি হোম খুলুন। আপনি লেখালেখি করলে গভর্নমেন্টও কিছু সাহায্য করবে। আমি আর মিনি ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনো করব।
প্রোফেসর লি বললেন–তোমার ধন্যবাদ, এ্যালিস। অতি দয়াবতী মেয়ে তুমি, কিন্তু তোমার টাকা নেব না। তা ছাড়া, এমন কোনো বড় আশ্রয়স্থল আমরা গড়তে পারব না, যাতে সকল দুঃস্থ বালক-বালিকাদের আমরা জায়গা দিতে পারি। সারা দক্ষিণ-চীন বিপন্ন, কত ছেলে-মেয়েকে আমরা পুষতে পারি? মাঝে পড়ে তোমার টাকাগুলি যাবে।
বিমল একটি জিনিস লক্ষ করেছে, এ্যালিসের ওপর প্রোফেসর লি-র স্নেহ নিজের সন্তানের ওপর পিতার স্নেহের মতোই। উনি চান না এ্যালিসের টাকাগুলি খরচ করিয়ে দিতে। নইলে উনি হোম গঠনের বিরুদ্ধে যে যুক্তি দেখালেন, সেটি এমন কিছু জোরালো নয়। সব দুঃস্থ লোকদের আশ্রয় দিতে পারছি নে বলে তাদের মধ্যে কাউকেও আশ্রয় দেব না?
এমন সময় সুরেশ্বর ও মিনি এসে বললে–এসো এ্যালিস, এসো বিমল, একটি জিনিস দেখে যাও।
ওরা বাগানের বেঞ্চি থেকে উঠে মন্দিরের উঁচু চত্বরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে দেখলে ওদের আগে আগে দু-টি চীনা তরুণ-তরুণী মন্দিরে উঠছে। তাদের হাতে ছোটো ছোটো ধ্বজা, মোমবাতি ও ফুল।
মিনি বললে–ওদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ছেলেটি বেশ ইংরেজি জানে। ওর ডাক পড়েছে যুদ্ধে, যুদ্ধে যাওয়ার আগে ওই মেয়েটিকে কাল বিয়ে করেছে; অনেকদিন থেকে মেয়েটি ওর বাগদত্তা। ফা-চীন মন্দিরে আশীর্বাদ নিতে এসেছে–
বিমল ও এ্যালিস নিজেদের অজ্ঞাতসারে শিউরে উঠল। বর্তমান যুগের ভীষণ মারণাস্ত্রের সামনে যুদ্ধ। আয়ু ফুরিয়ে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। একটি বোমার অপেক্ষা মাত্র। তরুণীর বয়স অল্প–ষোলো-সতেরো।
চীন দেশে সম্ভ্রান্ত-সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলিত নেই।
তরুণ-তরুণীর মুখ প্রফুল্ল ও হাস্যময়। কোনোদিকে ওদের লক্ষ নেই। মন্দিরের অন্ধকার গর্ভগৃহে মোমবাতি জ্বলছে। ওরা খোদাই-করা কাঠের চৌকাঠ পার হয়ে রাজকুমারী ফা-চীন এর কৃত্রিম সমাধির সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলে, ফুল ছড়িয়ে দিলে, দু-জনে পাশাপাশি বসে রইল খানিকক্ষণ চুপ করে। তারপর ওরা উঠল–ঘর থেকে বাইরে এসে মন্দিরের চত্বরে দাঁড়াল। দু-জনে দু-জনের হাত ধরে আছে–দু-জনের হাসি-হাসি মুখ।
এ্যালিস বললে–মিনি, ওঁদের এখানে দাঁড়াতে বলো না। আমাদের অনুরোধ—
মিনি বললে–আপনারা একটু দয়া করে যদি দাঁড়ান–মন্দিরের চত্বরে—
যুবক ওদের দিকে হাসিমুখে চাইল, তারপর মেয়েটিকে চীনাভাষায় কী বললে। তরুণীও অল্প হাসিমুখে ওদের দিকে একবার চেয়ে দেখে চোখ নীচু করলে।
যুবক হাসিমুখে বললে–ফোটো নেবে বুঝি? আলো নেই মোটে–ফোটো উঠবে?
এ্যালিস এই সময় মন্দিরের বাইরের ফুলের দোকান থেকে একরাশ ফুল কিনে নিয়ে এল। বৃদ্ধ লিকেও সে ডেকে এনেছে বাগান থেকে। হাসিমুখে বললে–ড্যাডি, এই ফুল নিয়ে ওদের আশীর্বাদ করুন– তোমরাও সবাই ফুল নাও।
যুবকের সঙ্গে প্রোফেসর লি চীনা ভাষায় কী কথাবার্তা বললেন, তারপর সকলে অর্ধচক্রাকারে ঘিরে দাঁড়াল নবদম্পতিকে।
প্রোফেসর লি চিনা ভাষায় গম্ভীর স্বরে কয়েকটি কথা উচ্চারণ করে ওদের ওপর ফুল ছড়িয়ে দিলেন–তারপর সকলে ফুল ছড়ালে ওদের ওপর। এ্যালিস ও মিনির কী হাসি ফুল ছড়াতে ছড়াতে।