সেই তরুণ ডেসপ্যাঁচ-রাইডারের দেহ অস্বাভাবিকভাবে শায়িত কিছুদুরে। রক্তে আশপাশের মাটি ভেসে গিয়েছে–একখানা হাত উড়ে গিয়েছে–বীভৎস দৃশ্য। সেদিকে চাওয়া যায় না।
কিন্তু দেখা গেল পলাতক গৃহহীন ব্যক্তিদের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। কয়েকটি ছেলে-মেয়ে এবং একটি বৃদ্ধ জখম হয়েছে মাত্র। পাইনবনের পাতার আড়ালে ছিল এরা–ওপর থেকে বোমার লক্ষ্য ঠিকমতো হয়নি।
প্রোফেসর লি-র সঙ্গে এ্যালিস ও মিনি আহতদের সাহায্যে অগ্রসর হল।
সন্ধ্যার পরে একখানা ট্রেন এসে দাঁড়াল। নাইনথ রুট আর্মির একটি ব্যাটালিয়ন ট্রেন থেকে নামল–এরা এসেছে রেলপথ রক্ষা করতে এবং দু-টি সাঁকো পাহারা দিতে।
বিমল সুরেশ্বরকে বললে–আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে বলতে গেলে একরকম বাস করছি, অথচ লড়াই যে কোনদিকে হচ্ছে–কীভাবে হচ্ছে–তা কিছুই জানিনে, চোখেও দেখতে পাচ্ছি নে।
রাত্রে কমাণ্ডান্টের সারকুলার বেরোলো– রেললাইনের প্রান্ত পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে–আজ শেষ রাত্রে জাপানিরা আক্রমণ করবে–সকলে তৈরি থাকো, যারা সৈন্য নয় যুদ্ধ করছে না–এমন শ্রেণির লোক দূরে চলে যাও।
রাত প্রায় বারোটা। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
সুরেশ্বর বর্ষাতি কোট গায়ে বাইরে থেকে হাসপাতাল তাঁবুতে ঢুকে বললে–আমাদের আয়ু মনে হচ্ছে ফুরিয়ে এসেছে। সারকুলার দেখেছ?
বিমল বললে–গতিক সেইরকমই বটে। জাপানিরা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড চার্জ করলে কেউ বাঁচবে না।
আমি ভাবছি মেয়েদের কথা—
প্রেফেসর লি-কে কথাটা বলা ভালো। উনি কি বলেন দেখি।
প্রোফেসর লি-কে ডাকতে গিয়ে একটি সুন্দর দৃশ্য বিমলের চোখে পড়ল। হাসপাতাল তাঁবুর পাশে একটি ছোট্ট চটে-ছাওয়া তাঁবুতে এ্যালিস ও মিনি কী রান্না করছে আগুনের ওপর—বৃদ্ধ লি ওদের কাছে উনুন ঘেঁষে বসে বুড়ো ঠাকুরদাদার মতো গল্প করছেন। এ্যালিস বললে–তোমার বন্ধু কোথায় বিমল–খেতে হবে না তোমাদের আজ? ড্যাডি আমাদের এখানে খাবেন। উঃ–কী সত্যি কথা। গোলমালে তার মনেই নেই যে সন্ধ্যা থেকে কারো পেটে কিছু যায়নি! বিমল সুরেশ্বরকে ডেকে নিয়ে এল। খাবার বিশেষ কিছু নেই। শুধু ভাত ও শুকনো সিঙ্গাপুরি কাঁচকলা, চর্বিতে ভাজা।
একজন ডেসপ্যাঁচ-রাইডার ব্যস্তভাবে তাঁবুর বাইরে এসে বিমলকে ডাক দিলে। তার হাতে একখানা ছোট্ট শিল-করা খাম।
আপনি হাসপাতালের ডাক্তার?
আপনার চিঠি। ট্রেন এখুনি একখানা আসছে। টেলিগ্রামে অর্ডার দিয়ে আনানো হচ্ছে। আপনি আপনার নার্স ও রোগী নিয়ে হ্যাং-কাউতে এই ট্রেনে যাবেন আপনাকে একথা বলার আদেশ আছে আমার ওপর। গুড নাইট।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। কেন হঠাৎ এ আদেশ জানেন?
আমরা এই রেলের জন্যে আর লোক ক্ষয় করব না। জেনারেল চু-টে-র আদেশ এসেছে হেডকোয়ার্টার্স থেকে। পরবর্তী যুদ্ধ হবে এর দশমাইল দূরে। আর এখুনি আপনারা তৈরি হোন। আজ শেষ রাত্রে জাপানিরা আড্ডা দখল করবে। তার আগে হয়তো গোলা ছুঁড়তে পারে।
প্রোফেসর লি কাছেই দাঁড়িয়ে সব শুনেছিলেন। তিনি বললেন–আমি এই ট্রেনে গরিব গ্রামবাসীদের উঠিয়ে নিয়ে যাব। নইলে জাপানি বোমা থেকে যাও-বা বেঁচেছে, গোলা আর হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড খেলে তাও যাবে। আপনি দয়া করে আমার এই অনুরোধ কমাণ্ডান্টকে জানিয়ে আমায় খবর দিয়ে যাবেন?
ডেসপ্যাঁচ-রাইডার অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হল।
আরও দেড়ঘণ্টা পরে এল ট্রেন। প্রায় খালি। তবে পেছনের গাড়িগুলি পুঁটকি মাছ বোঝাই –বিষম দুর্গন্ধ। বিমল হাসপাতালের সব লোকজন নিয়ে ট্রেনে উঠল–মিনি, এ্যালিস, দুটি চীনা নার্স, সাত-আটটি রোগী। প্রোফেসর লি ইতিমধ্যে তাঁর দলবল নিয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কিন্তু ট্রেনের সামরিক গার্ড কমাণ্ডান্টের বিনা আদেশে তাঁর দলবল গাড়িতে ওঠাতে চাইলে না।
এ্যালিস বললে–বিমল, ওদের বলো তাহলে আমরাও যাব না। ওঁকে ফেলে আমরা যাব না। ট্রেনের সামরিক গার্ড বললে–আমার কোনো হাত নেই। আপনারা না যান, পনেরো মিনিট পরে আমি গাড়ি ছেড়ে দেব।
এ্যালিস ও মিনি নামল। চীনা নার্স দু-টিও এদের দেখাদেখি নাবল। ট্রেনের গার্ড বললে– রোগীরা কাদের চার্জে যাবে? একজন ডাক্তার চাই। আমি রিপোর্ট করলে আপনাদের কোর্ট মার্শাল হবে। আপনারা হাসপাতালের কর্মচারী, সামরিক আদেশ অনুসারে কাজ করতে বাধ্য।
বিমল বললে–সে এঁরা নন–এই মেয়ে দু-টি। এঁরা আমেরিকান রেডক্রস সোসাইটির। চীনা পার্লামেন্টের হাত নেই এদের ওপর।
এদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হচ্ছে, এমন সময়ে ডেসপ্যাঁচ-রাইডারটিকে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে দেখা গেল এবং কিছুক্ষণ পরে প্রোফেসর লি তাঁর দলবল নিয়ে হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠে পড়লেন। ট্রেনও ছেড়ে দিল।
.
দিন পনেরো পরে।
হ্যাং-কাউ শহরের উপকণ্ঠে পবিত্র ফা-চীন মন্দির। মিং রাজবংশের রাজকুমারী ফা-চিন তাঁর প্রণয়ীর স্মৃতির মান রাখবার জন্যে চিরকুমারী ছিলেন–এবং একটি ক্ষুদ্র বৌদ্ধ মঠে দেহত্যাগ করেন একষট্টি বছর বয়সে। তাঁর দেহের পুণ্য ভস্মরাশির ওপরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের চারিধারে অতি মনোরম উদ্যান ও ফোয়ারা।
সন্ধ্যার কিছু পূর্বে এ্যালিস ও বিমল মার্বেলের চৌবাচ্চায় মন্দিরের অতি বিখ্যাত লাল মাছ দেখছিল। অনেক দূর থেকে লোকে এই লাল মাছ দেখতে আসে–আর আসে নব-বিবাহিত দম্পতি–তাদের বিবাহিত জীবনের কল্যাণ কামনায়।