আমিও যে তা না ভেবেছি এমন নয়। কিন্তু সাংহাই পর্যন্ত কোনো ট্রেন এখান থেকে যাচ্ছে তো? আচ্ছা, কমাণ্ডান্টকে বলে দেখি।
আবার চারজন আহত সৈনিককে স্ট্রেচারে করে আনা হল। একজনের মাথার খুলির অর্ধেকটা উড়ে গিয়েছে বললেই হয়। বিমল বললে–এ তো গেল! একে এখানে কেন এনেছে?
কিন্তু অদ্ভুত জীবনীশক্তি চীনা সৈনিকটির। মাথার ব্যাণ্ডেজ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, দু-বার ব্যাণ্ডেজ বদলাতে হল, তবুও সৈনিকটি মারা গেল না–বিমল ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলে।
একজন সৈনিক ডেসপ্যাঁচ-রাইডার হাসপাতাসে ঢুকে বললে–আমাদের তাঁবু ওঠাতে হবে এখান থেকে–শত্রু খুব নিকটে এসে পড়েছে। রেললাইনের ওপর ওদের লক্ষ কিনা? রেললাইনটি দখল করবে। আমাদের সৈন্য প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে কিন্তু আজ সারাদিনে জাপানিরা প্রায় একমাইল এগিয়েছে। দেখবে এসো।
তারপরে সৈনিকটি একটা ফিল্ড গ্লাস বার করে বিমলের হাতে দিয়ে বললে–পূর্ব দিকে ওই যে গাঁ-খানা দেখা যাচ্ছে ওদিকে চেয়ে দেখো–বিমল একখানা গ্রাম বেশ স্পষ্ট দেখছিল, কিন্তু তার অতিরিক্ত কিছু না। সৈনিকটি বললে–ওই গ্রামখানির পেছনেই শত্রুর লাইন। গ্রামখানা দখল করতে ওরা আজ ক-দিন চেষ্টা করছে–ওখানেই আমরা বাধা দিচ্ছিলাম। আজ গ্রামের অর্ধেকটা দখল করেছে। সুতরাং, বোধ হয় কাল কী পরশু রেললাইনে এসে পৌঁছোবে।
গ্রামে লোকজন আছে?
পাগল! কবে পালিয়েছে। পশ্চিম দিকে একটা নদী আছে–তার ওপারে পলাতক গৃহহারাদের একটা বস্তি বসে গেছে। আট-দশখানা গ্রামের লোক জড়ো হয়েছে ওখানে।
খাবার দিচ্ছে কে?
কে দেবে? অনাহারে অনেকে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দুর্দশা দেখলে বুঝবে বর্তমান কালের যুদ্ধ কী নিষ্ঠুর ব্যাপার।
বিমল কথায় কথায় জানতে পারলে, ডেসপ্যাঁচ রাইডার সৈনিকটি শিক্ষিত ভদ্রসন্তান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট–পূর্বে স্কুল মাস্টারি করত, যুদ্ধ বাধবার পর সৈন্যদলে যোগ দিয়েছে।
বিমল বললে–তুমি আমাকে ওই গ্রামে নিয়ে চলো না।
এমনিই তো যেতে হবে। বোধ হয় ওখানেই হাসপাতাল উঠে যাবে–কারণ শত্রুর লাইন থেকে জায়গাটা দূরে।
এরোপ্লেন থেকে বোমা ফেলতে বারণ করেছে কে? কেউ না। সে তো সর্বত্রই ফেলছে। তবে একটি পাইনবনের তলায় এ বস্তি–জাপানি প্লেন হঠাৎ সন্ধান পাবে না। ভয়ে ওরা রান্না করে না।–পাছে ধোঁয়া দেখে বোমারু প্লেন সন্ধান পায়।
সৈনিকটি চলে গেলে বিমল এ্যালিসকে ডেকে কথাটি বলতে যাচ্ছে, এমন সময় একখানা ট্রেনের শব্দ শোনা গেল দূরে।
এ্যালিস তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে এসে বললে–ট্রেন আসছে, না এরোপ্লেন? বিমল বললে–ট্রেনই। বোধ হয় আরও সৈন্য আসছে। চলো দেখি গিয়ে। অনেকে রেললাইনের ধারে জড়ো হল। এখানে স্টেশন নেই। একজন লোক নিশান হাতে অপেক্ষা করছিল–নিশান দেখিয়ে ট্রেন দাঁড় করাবে। ট্রেন এসে পড়ল। সারি সারি খোলা মালগাড়িতে সৈন্য বোঝাই– অন্য সাধারণ যাত্রীও আছে। কতকগুলি ছাদ-আঁটা মাল-গাড়ি পেছনের দিকে–তাতে সৈন্যদের রসদ বোঝাই।
গাড়ি থেকে দলে দলে সৈন্য নামতে লাগল। জাপানি সৈন্যদের হাত থেকে গ্রাম রক্ষা করবার জন্যে এরা আসছে ক্যান্টন থেকে। রসদ বোঝাই মালগাড়িগুলি থেকে রসদ নামানোর ব্যবস্থা করা হতে লাগল–কারণ বেশিক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকলে এখুনি কোনদিক থেকে জাপানি বিমান আকাশপথে দেখা দেবে হয়তো। হঠাৎ এ্যালিস উত্তেজিত সুরে বললে–বিমল, বিমল–ও কে? প্রোফেসর লি না?
তারপরেই সে হাসিমুখে সামনের দিকে ভিড়ের মধ্যে ছুটে গেল—ড্যাডি–ড্যাডি—
সত্যিই তো–হ্যাঁস্যমুখ বৃদ্ধ একটি বড়ো ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে ভিড় ঠেলে বাইরে আসতে চেষ্টা করছেন।
বিমল এগিয়ে গিয়ে বললে–নমস্কার প্রোফেসর লি–ব্যাগটা আমার হাতে দিন। আপনি কোথা থেকে?
এ্যালিস ততক্ষণ গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। বৃদ্ধ তার কাঁধে সস্নেহে হাত রেখে বিমলের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন–তোমরা এখানে আছ? বেশ বেশ। আমি এসেছি পলাতক গ্রামবাসীদের যে বস্তি আছে নদীর ওপারে–সেখানে কয়েক পিপে আপেল বিলি করতে। আমেরিকান জুনিয়র রেডক্রস দু-শো পিপে ভালো ক্যালিফোর্নিয়ার আপেল পাঠিয়েছে দুঃস্থ বালক-বালিকাদের খাওয়ানোর জন্যে। আমার ঠিকানাতেই পাঠিয়েছিল। আর সব বিলি করে দিয়েছি অন্য অন্য স্থানে–দশ পিপে মজুত আছে এখনও। তা তোমরা আছ ভালোই হয়েছে–তোমরা সাহায্য করো এখন।
এ্যালিস তো বেজায় খুশি। বললে–ড্যাডি, খুব ভালো কথা। তা বাদে আরও অনেক কাজ হবে যখন তুমি এসে পড়েছ। চলো, আপেলের পিপে সব নামিয়ে নিই।
এমন সময় মিনি ভিড়ের মধ্যে কোথা থেকে ছুটে এসে ব্যস্তভাবে বললে–শিগগির এসো বিমল, শিগগির এসো এ্যালিস–সুরেশ্বর নামছে ওই দেখো ট্রেন থেকে
সুরেশ্বর সত্যিই নামছে বটে–তার সঙ্গে দু-জন চীনা ডাক্তার, এদেরও বিমল চেনে– সাংহাই চীনা রেডক্রস হাসপাতালে এরা ছিল।
বিমল বললে–প্রোফেসর লি–একটু আমায় ক্ষমা করুন, পাঁচমিনিটের জন্যে আসছি।
সুরেশ্বর তো ওদের দেখে অবাক। বললে– তোমরা এখানে! মিনি আর এ্যালিসই বা এখানে কী করে এল! সাংহাইতে বেজায় গুজব এদের চীনা গুন্ডারা গুম করেছে–আর বিমল তুমি জাপানিদের হাতে বন্দি। মিনি কেমন আছে?
বিমল বললে–সেসব কথা হবে এখন। চলো এখন সবাই মিলে তাঁবুতে গিয়ে বসা যাক। অনেক কথা আছে। প্রোফেসর লি-কে ডেকে আনি–উনিও আমাদের সঙ্গে আসুন। তোমরা এগিয়ে চলো ততক্ষণ। আমি ওঁর আপেলের পিপেগুলি নামাবার কী ব্যবস্থা হল দেখে আসি।