বৃদ্ধ বললেন–এখন তোমরা যাও খুকিরা–শিগগির আমার সঙ্গে দেখা হবে। এ কাজ তোমাদের নয়।
ট্রেন আবার চলল।
দু-ধারে শস্যক্ষেত্র, মাঝে মাঝে ধোঁয়ায় কালো অগ্নিদগ্ধ গ্রাম। জাপানি বোমারু বিমানের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন।
এ্যালিস বললে–বিমল, আমার কী মনে হচ্ছে জান? প্রোফেসর লি-কে আবার আমাদের মধ্যে পেতে। এত ভালো লেগেছে ওঁকে! আমার নিজের বাবা নেই, ওকে দেখে সেই বাবার কথা মনে আসে।
বিমল দেখলে এ্যালিসের বড়ো বড়ো চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে।
মিনি বললে–আমারও বড়ো ভক্তি হয় সত্যি! ভারি চমৎকার লোক।
বিমল বললে–অথচ কীভাবে ওঁর সঙ্গে আলাপ তা জান? আমি যখন প্রথম চীনদেশে আসি–আজ প্রায় একবছর আগের কথা–তখন হ্যাং-চাউ রেলস্টেশনে উনি ওঁর ছাত্রদল নিয়ে উঠলেন–বললেন, যুদ্ধের সময় ওখানকার মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে যাচ্ছেন। শুনে আমার হাসি পেয়েছিল।
এ্যালিস বললে–তখন কী জানতে উনি একজন মহাপুরুষ লোক! উনি যুদ্ধ-উপদ্রুত অঞ্চলের মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে এসেছিলেন এটা ঠিকই কিন্তু পরের দুঃখ দেখে সেসব ওঁর ভেসে গেল। People such as these are the salts of the Earth-নয় কী?
বিমল মৃদু হেসে চুপ করে রইল।
একটি নদীর পুল বোমায় ভেঙে গিয়েছে। আর ট্রেন যাবার উপায় নেই। রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মচারীরা দিনরাত খাটছে যদি পুলটা কোনো রকমে মেরামত করে কাজ চালানো যায়।
কাছেই একটা তাঁবু। মাঠের মধ্যে কিছুদূরে জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে। এটা ফিল্ড হাসপাতাল।
ট্রেন থেকে মেয়ে-সৈন্যদের পথেই নামিয়ে দেওয়া হল। ট্রেনখানা যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে যাবে বলে পিছু হঠে চলে গেল। কোনো বড়ো স্টেশনে গিয়ে এঞ্জিনখানা সোজা করে জুড়ে নেবে। সম্পূর্ণ নতুন জায়গা। যেন অনেকটা পূর্ববঙ্গের বড়ো বড়ো জলা অঞ্চলের মতো। ফসলের খেত নেই–সামনে একটি বিল কিংবা ওই ধরনের জলাশয়–দীর্ঘ দীর্ঘ জলজ ঘাসের বন জলের ধারে। দূরে দূরে মেঘের মতো নীল পাহাড়। জায়গাটার নাম সিং চাং। বিমল নেমে চারিদিক দেখে অবাক হয়ে গেল।
ট্রেনে করে এতদূরে এসে এখানে আবার যুদ্ধক্ষেত্র কী করে এল।
বিমলের ধারণা ছিল জাপানিদের আসল ঘাঁটি কোনকালে পার হয়ে আসা গিয়েছে।
কিন্তু কমাণ্ডান্ট তাকে বুঝিয়ে বললেন–এখান থেকে আরও প্রায় পঁচিশ মাইল দূর হ্যাং কাউ শহর পর্যন্ত ওদের সৈন্যরেখা বিস্তৃত। সমুদ্রের উপকূলভাগে অনেক দূর অবধি ওরা নিজেদের লাইন ছড়িয়ে রেখেছে। মাটিতে একটা নকশা এঁকে বুঝিয়েও দিলেন।
বিমল একটি অনুচ্চ ঢিবির ওপর উঠে চারিদিকে চেয়ে দেখলে।
কিছুদূরে একটি গ্রাম–পাশে কাদের অনেকগুলি ছোটো বড়ো তাঁবু–সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে, বোধ হয় রান্নাবান্না চলেছে। পশ্চিম দিকে একটি বড়ো শস্যক্ষেত্র, তার ধারে লম্বা লম্বা কী গাছের সারি। মোটের ওপর সবটা নিয়ে বেশ শান্তিপূর্ণ পল্লিদৃশ্য।
এ কী ধরনের যুদ্ধক্ষেত্র?
কিন্তু বিমলদের সেখানে উপস্থিত হবার আধ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ-ছ-জন আহত সৈন্যকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতাল তাঁবুতে আনা হল। সকলেই রাইফেলের গুলিতে আহত।
বিমল জিজ্ঞেস করে জানল যুদ্ধক্ষেত্র যে বেশিদূর তাও নয়–ওই গাছের সারির পাশেই, এখান থেকে আধমাইলের মধ্যে। একটি ক্ষুদ্র গ্রাম জাপানিরা দখল করে সেখানে ঘাঁটি করেছে–চীনা সৈন্য ওদের সেখান থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছে।
কমাণ্ডান্টের আদেশে মেয়ে-সৈনিকরা রান্নাবান্না করে খাবার আয়োজন করতে লাগল– কারণ অনেকক্ষণ তারা বিশেষ কিছু খায়নি। বিমল বললে–খাইয়ে নিয়ে এদের কী এখন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হবে? কমাণ্ডান্ট বললে–না, এরা পরিশ্রান্ত। ক্লান্ত সৈন্যদের দিয়ে যুদ্ধ হয় না–ওদের অন্তত দশঘণ্টা বিশ্রাম করতে দেব।
তারপর?
তারপর যুদ্ধে পাঠাতে পারি–রিজার্ভ রাখতে পারি। এখান থেকে সাত মাইল দূরে হ্যাং কাউ-ক্যান্টন রেলের ধারে একটি গ্রামে নাইনথ রুট আর্মির এক ঘাঁটি। সেখানে জেনারেল মাও-সি-তুং আছেন–তাঁর হুকুমমতো কাজ হবে।
হুকুম আসবে কী করে?
ঘোড়ার পিঠে যায় আসে ডেসপ্যাঁচ দল। আমাদের ফিল্ড টেলিফোন নেই।
কমাণ্ডান্টের সঙ্গে কথা বলে ফিরে গিয়ে বিমল হাসপাতাল তাঁবুতে আহত সৈন্যদের চিকিৎসার কাজে মন দিল। তিনটি হতভাগ্য সৈনিক কোননাপ্রকার সাহায্য পাবার পূর্বেই মারা গেল। বাকি কয়েকজনের করুণ আর্তনাদে হাসপাতাল মুখরিত হয়ে উঠল। কী নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক ব্যাপার এই যুদ্ধ! একথা বিমলের মনে না এসে পারল না।
এ্যালিস এসে বললে–এদের জন্যে বৃথা চেষ্টা। এদের একজনও বাঁচবে না।
বিমল বললে–তাই মনে হয়। না আছে ওষুধ, না আছে যন্ত্রপাতি, কী দিয়ে চিকিৎসা করব?
বিমল, এদের জন্যে আমেরিকান রেডক্রসে লিখে কিছু জিনিস আনার চেষ্টা করব?
লেখো না। নইলে সত্যি বলছি আমাদের খাটুনি বৃথা হবে।
ঠিকই তো? এটা কি একটা হাসপাতাল? কী ছাই আছে এখানে?
মিনি কোথায় গেল?
সে রাঁধছে। খেতে হবে তো? রাঁধবার কোনো বন্দোবস্ত নেই। দু-টি চাল ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।
টিনবন্দি খাবার কিছু সাংহাই থেকে আনিয়ে নিই। ও খেয়ে তোমরা বাঁচবে না।
একটা কথা শোনো। তুমি একবার সাংহাই যাও–মিনি সুরেশ্বর সম্বন্ধে বড়ো উদবিগ্ন হয়েছে আমায় বলছিল। ও আমায় কাল থেকে বলছে তোমায় বলতে।