মাইল ত্রিশেক দু-ধারে ফাঁকা মাঠ, ধানের খেত, গমের খেতের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলল। বেলা প্রায় পাঁচটা বাজে, রোদ নেই। মাঠে ঘন ছায়া পড়ে এসেছে। এমন সময় একটি পরিচিত আওয়াজ শুনে বিমলের বুকের মধ্যেটা কেমন করে উঠল। মুখ উঁচু করে দেখতে গিয়ে দেখলে ট্রেনের সবাই মুখ তুলে চেয়ে রয়েছে। অনেকগুলি এরোপ্লেনের সম্মিলিতি ঘড় ঘড় আওয়াজ। ট্রেন যেন গতি বাড়িয়ে দিয়ে জোরে চলতে লাগল।
মিনি বললে–ওই দেখো বিমল এরোপ্লেনের সারি! বম্বার!
চক্ষের নিমেষে এরোপ্লেনের সারি নিকটবর্তী হল–কিন্তু ট্রেনখানাকে গ্রাহ্য না করেই যেন এরোপ্লেনগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যাচ্ছিল–হঠাৎ একখানা বম্বার দল ছেড়ে বেশ নীচু হয়ে এল। ট্রেনের সকলের মুখ শুকিয়েছিল আগেই–এখন যেন বুকের রক্ত পর্যন্ত জমে গেল। এই ফাঁকা মাঠে বোমা ফেললে ট্রেনের চিহ্ন খুঁজে মিলবে না। তার ওপরে ছাদ-খোলা ট্রাক গাড়ি বোঝাই সৈন্য, কারো মৃতদেহ এর পর সনাক্ত পর্যন্ত করা যাবে না। এ্যালিস ও মিনিকে বাঁচানো গেল না শেষে।
এরোপ্লেনখানা নীচে নেমে ছোঁ-মারা চিলের মতো একটি বোমা ফেলেই তখনি ওপরে উঠে গেল। সঙ্গেসঙ্গে ভীষণ বিস্ফোরণের শব্দ! সমস্ত ট্রেনখানা কেঁপে নড়ে উঠল যেন, কিন্তু ট্রেনের বেগ কমল না। বিমল চেয়ে দেখলে রেললাইন থেকে দশ গজ দূরে একটি জায়গায় বিশাল গর্তের সৃষ্টি করে মাটি, ধুলো, ঘাস, বালি অন্তত পঁচিশ ত্রিশ হাত উর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করে কালো ধোঁয়ার আবরণের মধ্যে বোমাটি সমাধি লাভ করেছে। বোমারু তাগ ঠিক করতে পারেনি।
আর মাইল পাঁচ-ছয় পরে একটি রেলস্টেশন। গাড়িখানা সেখানে গিয়ে দাঁড়াবার পূর্বেই দেখা গেল স্টেশন থেকে প্রচুর ধোঁয়া বেরোচ্ছে–লোকজন ছোটাছুটি করছে–একটা হট্টগোল, কলরব, ব্যস্ততার ভাব। ট্রেনখানা স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াতেই বোঝা গেল জাপানি বিমান থেকে বোমা ফেলে স্টেশনটিকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। টিনের ছাদ দুমড়ে বেঁকে ছিটকে বহু দূরে গিয়ে পড়েছে, একপাশে আগুন লেগে গিয়েছে–গোটা প্ল্যাটফর্মে মানুষের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ, কারো হাত, কারো পা, কারো মুন্ড।
নিকটে একখানা গ্রাম। গ্রামের চিহ্ন রাখেনি বোমারুর দল। ইনসেনডিয়ারি বোমা ফেলে সারাগ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ট্রেন থেকে সবাই নেমে সাহায্য করতে ছুটল। গ্রামের লোক বেশি মরেনি–তবুও বিমল দেখলে গ্রামের পথে চার-পাঁচটা বীভৎস মৃতদেহ পড়ে আছে। এরোপ্লেনগুলির চিহ্ন নেই আকাশে, তাদের কাজ শেষ করে তারা চলে গিয়েছে। গ্রামের নর-নারী ভয়ে বিহ্বল হয়ে মাঠের মধ্যে ছুটে পালিয়েছিল, যদিও বিপদের সম্ভাবনা ছিল সেখানেই সর্বাপেক্ষা বেশি, একটি মেয়ে একা ভাঙা ঘরের সামনে ভাঙাচোরা হাঁড়িকুড়ি বেতের পেটরা কুড়িয়ে এক জায়গায় জড়ো করছে আর কাঁদছে। একজন মেয়ে-সৈন্য তার কাছে গিয়ে চীনা ভাষায় কী জিজ্ঞেস করলে। বিমলের দল গ্রামের অন্য অন্য লোকজনের সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
একটু পরেই সেখানে ভারি একটি অদ্ভুত দৃশ্য সবারই চোখে পড়ল।
গ্রামের পাশে একটা ছোট্ট মাঠ–তারই এক গাছতলায় জনৈক বৃদ্ধ গ্রামের লোকজনকে চারিপাশে নিয়ে কী বলছেন বক্তৃতার ধরনে। বিমল চিনলে–প্রোফেসর লি!
এ্যালিস সকলের আগে এগিয়ে গিয়ে বললে–ড্যাডি! চিনতে পার?
সৌম্য মূর্তি শ্বেতশ্মশ্রু বৃদ্ধ বক্তৃতা থামিয়ে একগাল হেসে ওর দিকে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন–তোমরা কোথা থেকে?
এ্যালিস হেসে বললে–এই ট্রেন থেকে নামলাম। আর একটু হলে আমাদের কাউকে দেখতে পেতে না–আমাদের ট্রেনেও বোমা পড়েছিল।
বিমল বললে–গুডমর্নিং, প্রোফেসর লি। আপনার দলবল কোথায়? আপনি কী করছেন এখানে?
বৃদ্ধ বললে–দলবল এখান থেকে তিন মাইল দূরে আর একখানা বোমায় বিধ্বস্ত গ্রামে সাহায্য করছে। আমি এদের উপদেশ দিচ্ছি এরোপ্লেন বোমা ফেলতে এলে কী করে আত্মরক্ষা করতে হয়। এরা কিছুই জানে না–দাঁড়িয়ে মরছে, নইলে দেখো গ্রামের অধিকাংশ লোক ফাঁকা মাঠে ছুটে পালায়?
–আপনাকে তো সর্বত্র দেখি, প্রোফেসর লি। পরের সাহায্য করতে এমন আর ক-জন লোক চীনদেশে আছেন জানি না। আপনাকে দেখে আপনার দেশের ওপর ভক্তি আমার অনেক বেড়ে গেল।
প্রোফেসর লি হেসে বললেন–আমার দেশ অতি হতভাগ্য, আমরা অতি প্রাচীন সভ্য জাতি কিন্তু জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছি। ভগবান নদীর এক কূল ভাঙেন আর এক কূল গড়েন। জাপান আজ উঠছে–আবার আমাদের দিন আসবে। আমার দিন ফুরিয়ে আসছে, যে ক-দিন বাঁচি, মূঢ়তা ও বর্বরতার দ্বারা অত্যাচারিত দেশের সেবা করে দিন কাটিয়ে যেতে চাই কিন্তু আমার দ্বারা আর কতটুকু উপকারই বা হবে?
বিমল বললে–বড়ো ইচ্ছে ভারতবর্ষের প্রথা অনুসারে আপনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। আপনি কি অনুমতি করবেন? বৃদ্ধ মহাচীন যেন তাঁর সন্তানদের রক্ষা করেন আপনার মূর্তিতে।
বিমলের দেখাদেখি মিনি, এ্যালিস এবং আরও কয়েকটি মেয়ে-সৈনিক বৃদ্ধের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে হাসিমুখে।
ট্রেন হুইসল দিলে। কমাণ্ডান্টের হুকুম শোনা গেল–ট্রেনে গিয়ে উঠে পড়ো।
এ্যালিস বললে–ড্যাডি, তোমার সঙ্গে কোথায় আবার দেখা হবে? আমরা দু-টি মেয়ে এবং আমার এই ভারতবর্ষীয় বন্ধুটি তোমার সঙ্গে থেকে কাজ করতে চাই–অনুমতি দেবে ড্যাডি?