ফটাফট–ফটাফট—
আবার একটি অস্ফুট শব্দ। তারপর বিমল চেয়ে দেখলে চিৎকার না করেও সারির মাঝামাঝি দু-টি মেয়ে উপুড় অবস্থাতেই মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছে। হাতের শিথিল মুঠিতে তখনও রাইফেল ধরাই রয়েছে। তার মধ্যে একটি মেয়ের মুখ থেকে রক্ত বার হয়ে সামনের মাটি রাঙা হয়ে গিয়েছে। আর একটি মেয়েও দেখতে দেখতে মুখ গুঁজে পড়ে গেল। আঃ– কী ভীষণ হত্যাকান্ড! পুরুষদের এ-রকম অবস্থায় দেখলে সহ্য করা হয় তো যায়–কিন্তু এই ধরনের নারীবলির দৃশ্যটা বিমলের কাছে অতি করুণ ও অসহনীয় হয়ে উঠল।
বিমল বললে–এ্যালিস। কমাণ্ডান্টটি কেমন লোক? এদের দাঁড়িয়ে খুন করাচ্ছে কেন? হঠে যাবার অর্ডার না দেওয়ার মানে কী? জাপানিরা বেওনেট কি হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড চার্জ করলে একজনও বাঁচবে?
এ্যালিস বিমলের পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে–তার ওদিকে মিনি।
মিনি বললে–কমাণ্ডান্টের এ-রকম ব্যবহারের নিশ্চয়ই কোনো মানে আছে। মানে কী আছে তা জানবার আগেই আরও দু-টি মেয়ে মুখ খুঁজড়ে পড়ে গেল–এদের এই নিঃশব্দ মৃত্যু বিমলের কাছে বড়ো মর্মস্পর্শী বলে মনে হল। হঠাৎ একটা লম্বা কাশীর পেয়ারার আকারে বস্তু শায়িতা মেয়েদের সারির অদূরে এসে পড়ল–বিমল ও এ্যালিস দু জনেই বলে উঠল–গ্রেনেড!
কিন্তু হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডটা ফাটল না। বোধ হয় এবার জাপানিরা চার্জ করবে। এ্যালিস ও মিনির জন্যে বিমল শঙ্কিত হয়ে উঠল।
ঠিক সেই সময় কমাণ্ডান্ট ওদের হঠবার অর্ডার দিলে।
পেছনের সারি শুয়ে-শুয়েই পিছু দিকে হঠতে লাগল। সামনের সারিগুলি ততক্ষণ রাইফেল বাগিয়ে তাদের রক্ষা করছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সামনের সারিও হঠতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে জাপানিরা চার্জ করলে। দলে দলে ওরা ঢিবিটা পেরিয়ে বানজাই বলে ভীষণ বাজখাঁই চিৎকার করতে করতে ছুটে এল–এদিকে নারী-বাহিনীর সব বন্দুকগুলি একসঙ্গে গর্জন করে উঠল। এখানে-ওখানে জাপানি সৈন্য ধুপ-ধাপ করে মুখ থুবড়ে পড়তে লাগল। তবুও ওদের দল এগিয়ে আসছে।
সব পেছনের সারি উঠে দাঁড়িয়ে একযোগে সাত-আটটা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ছুড়ল, চার-পাঁচটা ফাটল। আরও কতকগুলি জাপানি সৈন্য মাটিতে পড়ে গেল। তিন জন মাত্র জাপানি এদের দলের মধ্যে এসে পৌঁছেছিল। তাদের মধ্যে দু-জন বেওনেটের ঘায়ে সাংঘাতিক আহত হল–বাকি একজনের মাথায় গুলি লেগে সাবাড় হল।
ততক্ষণ নারী-বাহিনী প্রায় এক-শো-দেড়-শো গজ দূরে চলে গিয়েছে। এতদূর থেকে হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড কোনো কাজে আসবে না– কেবল কার্যকরী হতে পারে মিলস বম্ব জাতীয় বোমা। সে কোনো দলের কাছেই নেই, বেশ বোঝা গেল।
কমাণ্ডান্ট বিমলকে ডেকে বললেন–এ-রকম কেন করেছি, আপনি বোধ হয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন। এর কিছু দূরে মিং-চাউ এর রেলস্টেশন। দু-টি সৈন্যবাহী ট্রেন পরপর চলে যাবার কথা। জাপানিরা রেলস্টেশন আক্রমণ করত। আমি ওদের বাধা দিয়ে এখানে আটকে রাখলাম। টাইম অনুসারে ট্রেন দু-টি চলে গিয়েছে। এখন আর আমার সৈন্যদের মৃত্যুর সম্মুখীন করা অনাবশ্যক। জাপানিরাও তা বুঝেছে, ওরাও আর আসবে না। ওদের লক্ষ্যস্থল আমরা নই– সেই ট্রেন দু-খানা।
কিন্তু এরোপ্লেন যদি বোমা ফেলে?
আমার ঘাঁটি পার করে দিলাম নিরাপদে–তারপর অন্য এলাকার লোক গিয়ে বুঝুক সে কথা।
মিং-চাউয়ের রেলস্টেশন পৌঁছে সবাই খাওয়া-দাওয়া করবার হুকুম পেলে। বিমল ব্যস্ত হয়ে পড়ল মিনি ও এ্যালিসকে কিছু খাওয়াতে। খাবার কিছুই নেই। অন্তত সভ্য খাদ্য কিছু নেই। কমাণ্ডান্টকে বলে কিছু চাল জোগাড় করে একটা গাছতলায় এ্যালিস একটি পুরোনো সসপ্যানে ভাত চাপিয়ে দিলে তিনজনের মতো।
বেলা প্রায় বারোটা। রৌদ্র বেশ প্রখর, কিন্তু গরম নেই, বেশ শীত।
ভাত প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময় দলে দলে ছোট্ট শীর্ণকায় ছেলে-মেয়ে গাছতলায় নীরবে এসে দাঁড়াল। তারা ক্ষুধার্তের ব্যগ্র দৃষ্টিতে সসপ্যানের দিকে চেয়ে রইল। জনৈক মেয়ে সৈনিক বললে–এরা আশপাশের গ্রামের দুর্ভিক্ষপীড়িত ছেলে-মেয়ে; আমাদের দেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ চলছে। ওরা খাবার লোভে এসেছে।
এ্যালিস বললে–পুওর লিটল ডিয়ারস! … ওদের কী খেতে দিই, বিমল?
বিমল মুশকিলে পড়ে গেল। নিজের খাওয়ার জন্যে নয়–মিনি এ্যালিস কত দিন পেট ভরে খায়নি বলেই ওদের খাওয়াতে ব্যর্থ ছিল। নিজে না হয় না খাবে, কিন্তু এ্যালিস যেমন মেয়ে নিজের মুখের ভাত সব এক্ষুনি তুলে দেবে এখন এদের।
সুখের বিষয় একটা সমাধান হল। ওরা চীনা ছেলে-মেয়ে, চীনা খাবার খেতে আপত্তি নেই। অন্য অন্য মেয়ে-সৈনিকরা ওদের দেশীয় খাদ্য কিছু দিলে। তারা চলে গেল তাই খেয়ে। এ্যালিসের ইচ্ছে ওদের মধ্যে একটা ছোট্ট ছেলে নিয়ে যায়। বললে–বিমল, বলো না ওদের মধ্যে কেউ আমার সঙ্গে যাবে। আমি খুব যত্ন করব। বিমল হাসলে, তা কী কখনো হয়?
একটু পরে একখানা ট্রেন এল। তাতে সব খোলা ট্রাক, কয়লার গাড়ির মতো। কম্যাণ্ডান্টের আদেশে সবাই তাতে উঠে পড়ল। ট্রেনের গার্ডের মুখে শোনা গেল জাপানিরা এখান থেকে বাইশ মাইল ডাউন লাইনে একখানা সৈন্যবাহী ট্রেন এরোপ্লেন থেকে বোমা মেরে উড়িয়ে চুরমার করে দিয়েছে।
ট্রেন ছাড়ল। গার্ড বললে–ভয়ানক বিপজ্জনক অবস্থা। ওরা প্রত্যেক সৈন্যবাহী ট্রেনের ওপর কড়া লক্ষ্য রেখেছে। পৌঁছে দিতে পারব কিনা নিরাপদে তার ঠিক নেই।