মিনি ও এ্যালিস তাদের গল্প বলে যাচ্ছিল। ওদের ভালো করে খেতে দেওয়া হয়েছে, কারণ ওদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল পেটভরে খাওয়া ওদের অদৃষ্টে অনেকদিন ধরে জোটেনি।
বিমল বললে–এখানে তোমরা কী করে এলে?
এ্যালিস বললে–এখনও ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না, কিন্তু বড় খুশি হয়েছি তোমায় দেখে, বিমল। আমরা তো আশঙ্কা করছিলাম জাপানিরা আক্রমণ করেছে–এইবার ঘর জ্বালিয়ে আমাদের বন্দি অবস্থায় পুড়িয়ে মারবে–কে আর উদ্ধার করবে আমাদের? আর আমাদের অস্তিত্ব জানেই বা কে?
কবে তোমরা এ গ্রামে এসেছ?
আজ তিন দিন হল খুব সম্ভব–কারণ দিনরাত্রির জ্ঞান আমাদের বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
কে তোমাদের আনে?
কয়েকজন চীনা দস্যু।
সাংহাইয়ের চর আড্ডায় তোমাদের নিয়ে গিয়েছিল ধরে?
এ্যালিস বিস্ময়ের সুরে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে–তুমি কী করে জানলে? বিমল হেসে বললে–আমি আর সুরেশ্বর সেই চড়ুর আড্ডাতে যাই তোমাদের খুঁজতে। কিন্তু বড়ো বিভ্রাট বেধে গেল সে রাত্রে। জাপানি বম্বারগুলি সেইরাত্রে ভীষণ বোমা বর্ষণ শুরু করলে। মিনি বললে, আমরা খুব জানি। আমরা তখন হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় একটি গোরুর গাড়ির মধ্যে শুয়ে। একটি বোমা তো আমাদের গাড়ির পাশে পড়ল।
এ্যালিস বললে–তারপর ওরা আমাদের নানা জায়গায় ঘোরালে। দশ হাজার ডলার মুক্তিপণ না দিলে আমাদের ছাড়বে না। দেশে বাপ-মায়ের কাছে চিঠি লিখবে বলে ঠিকানা চেয়েছিল–আমরা দিইনি। আজ ওরা আমাদের শাসিয়েছিল জাপানি সৈন্যেরা গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে–ঠিকানা যদি না দিই তবে ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখে পালাবে–আমরা নিঃশব্দে পুড়ে মরব। করেছিলও তাই। চীনা মেয়ে সৈন্যেরা না এলে জাপানিরা গ্রাম জ্বালিয়ে দিত। আমরাও পুড়ে মরতাম।
বিমল বললে–কী সর্বনাশ!
এ্যালিস বললে–সর্বনাশ আর কী, পুড়ে মরতাম এর আর সর্বনাশ কী? কতই তো মরছে! কিন্তু তুমি এখানে কী করে এলে বিমল?
আমাকে হাসপাতাল থেকে জাপানিরা বন্দি করে এনেছিল। আমি নাকি স্পাই। এতদিন গুলি করেই মারত যদি একথা ওদের না বলতুম যে ব্রিটিশ কনসুলেট অফিসে আমার নাম রেজেস্ট্রি করা আছে।
মিনি বললে–সুরেশ্বর কোথায় গেল একটা খোঁজ করতে হয়। আর আমেরিকান কনসুলেটে আমাদের বিষয়ে একটা খবর দিতে হয়–চলো কম্যাণ্ডান্টকে বলি।
জনকয়েক তরুণী চীনা মেয়ে-সৈন্য ওদের হাসিমুখে ঘিরে দাঁড়াল। এদের হাস্যদীপ্ত সুন্দর চেহারা বিমলের বড়ো ভালো লাগল, এমন একটি জিনিস নতুন দেখছে সে–বহুশতাব্দীর জড়তা দূর করে পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নারী–রণক্ষেত্রের নিষ্ঠুরতা, কঠোরতার মধ্যে। দেশের দুর্দিনে দেশমাতৃকার সেবাযজ্ঞে তারা আজ মস্ত বড় হোতা–মিথ্যে জড়তা, মিথ্যে লজ্জা-সঙ্কোচ দূর করে ফেলেছে টেনে।
একটি মেয়ে ইংরেজিতে বললে–তোমরা হ্যাং-চাউতে রাজকুমারী তাং-এর দেউল দেখেছ?
এ্যালিস বললে–না, সে কী?
পাঁচশো বছর আগে মিং রাজবংশের একজন রাজকুমারী ছিলেন তাং। তাঁর পুণ্যচরিত্র এখনও আমাদের দেশের লোকের মুখে মুখে আছে। এখান থেকে বেশি দূর নয়–দেখে যেও।
বিমল বললে–তুমি বেশ ইংরেজি বলতে পার তো?
মেয়েটি এমন হাসলে যে তার তেরচা চোখ দুটি বুজে গিয়ে দুটো কালো রেখার মতো দেখাতে লাগল।
ভালো ইংরেজি বলছি? তবুও এ ইয়াংকি ইংরেজি। মিশনারি স্কুলে পাঁচ বছর পড়েছিলুম এক সময়ে। ইংরেজি গান পর্যন্ত গাইতে পারি–শুনবে?
হঠাৎ বিউগল বেজে উঠল। সবাই ব্যস্ত হয়ে কমাণ্ডান্টের তাঁবুর দিকে চলল। এখনি মার্চ শুরু করতে হবে। খবর পাওয়া গিয়েছে জাপানিদের বড়ো একটি দল এখানে আসছে।
বিমল বাঁ-দিকে চেয়ে দেখলে।
একটা অনুচ্চ পাহাড়ের মতো লম্বা ঢিবির আড়াল থেকে মাঝে মাঝে যে সাদা ধোঁয়া বার হচ্ছে–আর সঙ্গেসঙ্গে ফটফট শব্দ হচ্ছে। শব্দটা অনেকটা যেন বিমলদের দেশের লিচু বাগানে পাখি তাড়াবার জন্যে চেরা বাঁশের ফটাফট আওয়াজের মতো।
রাইফেল ছোঁড়ার শব্দ। আধুনিক যুদ্ধে ব্যবহৃত রাইফেলে শব্দ হয় খুব কম–বিমল জানত।
সবাই বললে–মাথা নীচু করো–মাথা নীচু করো—
জাপানি সৈন্যরা আক্রমণ করে ওই ঢিবিটাতে আড়াল নিয়েছে–কিন্তু হয়তো এখুনি বেওনেট চার্জ করবে কিংবা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড নিয়ে ছুটে আসবে।
চক্ষের নিমেষে সবাই উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেলের মুখ ঢিবিটার দিকে ফেরালে। একটি মেয়ে হঠাৎ অস্পষ্ট চিৎকার করে উপুড় অবস্থা থেকে চিৎ হয়ে গেল–তার হাত থেকে বন্দুকটি ছিটকে গিয়ে পড়ল আর একটি মেয়ের পিঠের ওপরে– সে কিছু দূরে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল বন্দুক বাগিয়ে। এ্যালিস ছুটে উঠে গিয়ে মেয়েটির মাথা নিজের কোলে তুলে নিলে–আশপাশের মেয়েরা বললে–মাথা নীচু–মাথা নীচু–শুয়ে পড়ো—
বিমল শঙ্কিত চোখে অল্পক্ষণের জন্যে এ্যালিসের দিকে চেয়ে দেখলে–তারপর সেও উঠে গিয়ে এ্যালিসের পাশে বসল। আহত মেয়ে-সৈনিকের হাতের নাড়ি দেখে বললে–এ শেষ হয়ে গিয়েছে। এঃ এই দ্যাখো গলায় লেগেছে গুলি–তোমার কাপড় যে রক্তে ভেসে গেল।
এ্যালিসকে একরকম জোর করে টেনে বিমল তাকে আবার উপুড় করে শোয়ালে। বিমল ভাবছিল, এখুনি যদি দুর্দান্ত জাপানি গ্রেনেডিয়ারেরা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড নিয়ে ছুটে আসে ঢিবিটা ডিঙিয়ে, তবে এই শায়িতা নারী-সৈনিকের দল একটিও টিকবে না। জাপানি হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডের বিস্ফোরণের ফল অতি সাংঘাতিক, এদের কম্যাণ্ডান্ট কী ভরসায় এদের এখনও শুইয়ে রেখেছে? মরবে তো সবগুলিই মরবে। যা করে করুক, ওদের সৈন্য ওরা বাঁচাতে হয় বাঁচাক, নয় তো যা হয় করুক। কিন্তু মিনি ও এ্যালিসের জীবন আবার বিপন্ন হল।