বিমল এবার ব্যাপারটা কিছু কিছু বুঝলে। চীনা সৈন্যের একটা দল জাপানিদের অতর্কিতে আক্রমণ করেছে। জাপানিরা ফিল্ডগানগুলি একেবারে ছুঁড়তে পারলে না। দু-টির একটিও না। চীনারা বুদ্ধি করে আগেই সে দু-টি কামানই ঘেরাও করে দখল করলে। চীনা সৈন্যের এই দলটা হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ছুঁড়ে জাপানিদের দলের জটলা ভেঙে দিলে।
কিছুক্ষণ পরে রাইফেলের ও হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডের আওয়াজ থেমে গেল। জাপানিরা কামানের গাড়ি ও বন্দিদের ফেলে পালিয়েছে। বিমল বেশ দেখতে পেলে কাছাকাছি কোথাও জাপানি সৈন্য একটিও নেই। কাদামাখা পোশাকে সতর্কতার সঙ্গে সে ধীরে ধীরে ডোবার জল থেকে উঠল ডাঙায়।
একজন সৈনিকের চড়া আওয়াজ তার কানে গেল– কে ওখানে?
বিমল আশ্চর্য হল এ পুরুষের গলা নয়– মেয়েমানুষের মতো সরু গলা। বিমল কথার উত্তর দেবার আগে দু-জন রাইফেলধারী চীনা সৈনিক ওর দিকে এগিয়ে এল ইলেকট্রিক টর্চ হাতে। তারা ওকে দেখে যেমন অবাক হল, বিমলও ওদের দেখে তেমনি অবাক হয়ে গেল।
এরা পুরুষ মানুষ নয়, দু-জনেই মেয়ে; বয়েসও বেশি নয়। কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে। বেশ সুশ্রী দু-জনেই–সৈন্যবিভাগের আট-সাঁট খাকি পোশাকে এদের দেহের লাবণ্য বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি।
তারা বিমলকে ধরে নিয়ে গেল গ্রামের সদর রাস্তার ওপরে।
অবাক কান্ড! সকলেই মেয়ে সৈনিক! এদের মধ্যে পুরুষ মানুষ নেই একজনও। এই সুশ্রী তরুণীর দল এতক্ষণ হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ছুড়ছিল এবং এরাই জাপানি ফিল্ড গান দু-টি ঘেরাও করে দখল করেছে।
বিমলের মনে পড়ল চীনা নাইনথ-রুট আর্মির সঙ্গে একটি নারী বাহিনি আছে সে সাংহাই চীনা রেডক্রস হাসপাতালে শুনেছিল বটে।
এরাই সেই চীনা মেয়ে-যোদ্ধার দল।
এদের কমাণ্ডান্ট কিন্তু মেয়ে নয়–পুরুষ। একটি পাইনকাঠের পুরোনো ভাঙা টেবিলের সামনে সম্ভবত একটা উপুড় করা কলসি বা ওইরকম কোনো হাস্যকর জিনিস পেতে খুব লম্বা গোঁপওয়ালা কমাণ্ডান্ট বসেছিলেন। মেয়েরা বিমলকে ধরে নিয়ে গেল সেখানে।
বিমলের মনে হল সমগ্র নারী বাহিনীর মধ্যে এই লোকই ইংরেজি জানে এবং বেশ ভালো আমেরিকান টানের ইংরেজি বলে।
বিমলের আপাদমস্তক ভালো করে দেখে প্রশ্ন করলে–তুমি জাপানিদের লোক?
না। আমি চীনা হাসপাতালের ডাক্তার।
কোথাকার হাসপাতাল?
সাংহাইয়ের রেডক্রস হাসপাতাল। আমাকে ওরা বন্দি করে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল।
তুমি কোন দেশের লোক?
ভারতবর্ষের। চীনা মেডিকেল ইউনিটের আমি সভ্য।
কম্যাণ্ডান্ট বিস্ময়ের সুরে বললে–ও! তা ডোবায় জলে কী করছিলে? বিমল লজ্জিত হল। এতগুলি মেয়ের সামনে।
বললে–লুকিয়ে ছিলুম। ওদের অসতর্ক মুহূর্তে ওদের হাত থেকে পালিয়ে ডোবার জলে লুকিয়েছিলুম। তার পর হঠাৎ হ্যাঁণ্ডগ্রেনেডের আওয়াজ আর চিৎকার শুনলাম, তখনই ভাবলাম চীনা সৈন্য আক্রমণ করেছে ওদের।
কথাবার্তা চলছে এমন সময়ে গ্রামের পথে কী একটা গোলমাল উঠল। কমাণ্ডান্টকে ঘিরে যারা ছিল, তারা চমকে উঠে সেদিকে ছুটতে লাগল। আবার কি জাপানি সৈন্যের দল আক্রমণ করেছে?
বিমল চেয়ে দেখল জনকয়েক সৈন্য যেন কাউকে ধরে আনছে–তাদের পেছনে পেছনে অনেক সৈন্য মজা দেখতে আসছে।
ব্যাপার কী? হয়তো কোনো জাপানি সৈন্য ওদের হাতে ধরা পড়েছে, তাকে সকলে মিলে ধরে আনছে–নিশ্চয়ই।
কিন্তু দলটি কমাণ্ডান্টের কাছে এসে পৌঁছে যখন ওদের প্রথামতো সামরিক অভিবাদন করে দু-জন বন্দিকে এগিয়ে নিয়ে দাঁড় করালো কম্যাণ্ডান্টের সামনে–বিমল চমকে উঠে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। কারণ কিছুক্ষণ পরে তার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বর বেরোলো–এ্যালিস! মিনি! সামনের শীর্ণকায়া মূর্তি দু-টি এ্যালিস ও মিনি ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু ওদের হাত পা বাঁধা–মুখে কাপড় দিয়ে বাঁধা। এমন শক্ত করে বাঁধা যে ওদের কথা বলবার উপায় নেই।
ভয়ানক রাগ হল বিমলের এক মুহূর্তে এই চীনা নারী বাহিনীর ওপর। মেয়ে হয়ে মেয়ের ওপর এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার! ওদের এমন করে বেঁধে আনার অর্থ কী? ওরা ছিলই-বা কোথায়?
কম্যাণ্ডান্ট উত্তেজিত সুরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল। ইতিমধ্যে এ্যালিস ও মিনির হাত-পা মুখের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। ব্যাপারটি ক্রমশ যা জানা গেল তা হল এই
চীনা নারী সৈন্যেরা এদের গ্রামের একটি ঘরের মধ্যে অন্ধকার কোণে এই অবস্থাতেই পায়। বাইরে থেকে ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল–কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ সন্দেহ করে ওরা দরজা ভেঙে দেখতে পায় এদের। ওরা বুঝতে পেরেছে যে এরা ইউরোপীয় বা আমেরিকান মহিলা। কিন্তু চীনের এই সুদূর পাড়াগাঁয়ে একা অন্ধকার ঘরের কোণে এদের কে এ অবস্থায় এনে ফেলেছে তা না বুঝতে পেরে সবাই মহাবিস্ময়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
হঠাৎ বিমল বলে উঠল–এ্যালিস! মিনি!
প্রথমে চমকে উঠে ওর দিকে চাইলে এ্যালিস। বিমলকে দেখে সে যেন প্রথমটা চিনতে পারলে না–তারপর প্রায় ছুটে ওর কাছে এসে বিস্মিত চকিত আনন্দভরা কণ্ঠে বললে– তুমি এখানে!
সঙ্গেসঙ্গে মিনিও ছুটে এল। মিনির চেহারাটা বড্ড খারাপ হয়ে গিয়েছে নানা কষ্টে, উদবেগে, এবং খুব সম্ভবত অনাহারেও বটে। সে বললে, তোমার বন্ধু কই?
.
ঘণ্টা কয়েক পরে।
একটা রিচ গাছের তলায় বসে মিনি, এ্যালিস ও বিমল কথা বলছিল। এখনও রাত আছে, তবে পূর্ব আকাশে শুকতারা উঠেছে–ভোর হওয়ার বেশি দেরি নেই।