কিন্তু আন্তর্জাতিক কনসেশনে বোমা ফেলে আশ্রয়হীন চীনা নর-নারীদের মেরেছে, একথাটা বিমলের ভালো বিশ্বাস হল না। আন্তর্জাতিক কনসেশনে বোমা ফেলতে সাহস করে কখনো? ওটা নিতান্ত বাজে কথা বলছে।
ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কনসেশনের সম্পর্কে বিমলের এ অলৌকিক শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের ভাব দূর হয়েছিল–সাংহাই অধিকার করার পূর্বে ও পরে জাপানি বম্বার প্লেনগুলি সে কনসেশনের পবিত্রতা মানেনি–এ সংবাদ বিমল আরও ভালো জায়গা থেকে এর পরে শুনেছিল।
পথের মধ্যে একটা চীনা গ্রাম। বড়ো বড়ো ভুট্টাখেতের মধ্যে। তখন সন্ধ্যা হবার বেশি দেরি নেই। পূর্বোক্ত পাহাড় ও পাইনবন থেকে অন্তত পাঁচমাইল তখন আসা হয়েছে। জাপানি সৈন্যের একটা দল গ্রামটা দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠল–এবং সবাই তক্ষুনি হামাগুড়ি দিয়ে মাটিতে প্রায় বুক ঠেকিয়ে, চুপি চুপি অগ্রসর হতে লাগল গ্রামখানার দিকে। বিমল শুধু ভাবছিল, ভগবান করেন–গ্রামটাতে লোক না থাকে–সব যেন পালিয়ে গিয়ে থাকে।
কিন্তু তা হল না। এ গ্রামের লোক যুদ্ধের বিশেষ কোনো খবর রাখত না–সাংহাই থেকে অন্তত পনেরো-ষোলো মাইল দূরে এই গ্রামখানা। এরা বেশ নিশ্চিন্ত ছিল যে চীনা নাইনথ রুট আর্মি তাদের রক্ষা করছে। হঠাৎ যে নাইনথ-রুট আর্মি ঘাঁটি ছেড়ে দিয়েছে–তা ওরা সম্ভবত জানত না।
জাপানি সৈন্যরা গ্রামখানাকে আগে চুপি চুপি গোল করে ঘিরে ফেললে। গ্রামে অনেকগুলো সাদা সাদা খোলার ঘর, খড়ের ঘর। শস্যের গোলা, দোকানপত্রও আছে। বেশ করে ঘেরার পরে জাপানিরা হঠাৎ একযোগে ভীষণ পৈশাচিক চিৎকার করে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে নিদ্রিত নর-নারী ঘুম ভেঙে বাইরে এসে অনেকে দাঁড়াল–অনেকে ব্যাপারটা কী না বুঝতে পেরে বিস্ময় ও কৌতূহলের দৃষ্টিতে জানলা খুলে চেয়ে দেখতে লাগল।
তারপর যে দৃশ্যের সূচনা হল তা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি অমানুষিক। বিমলের চোখের সামনে বর্বর জাপানি সৈন্যেরা নিরীহ গ্রামবাসীদের টেনে টেনে ঘর থেকে বার করতে লাগল, এবং বিনা দোষে বেওনেটের কিংবা বন্দুকের কুঁদোর ঘায়ে তার মধ্যে সাত-আটজনকে একদম মেরে ফেললে। ছুতো এই যে, তারা নাকি বাধা দিয়েছিল। বাকিগুলিকে এক জায়গায় জড়ো করে দাঁড় করিয়ে রাখলে–চারিধারে বেওনেট-চড়ানো রাইফেল হাতে জাপানি সৈন্যের দল।
দু-তিনখানা খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে। দুটো ছোটো ছোটো বাছুরকে ভয় দেখিয়ে মজা করতে লাগল, একটা পিচ গাছের ডালগুলি অকারণে ভেঙে গাছটাকে ন্যাড়া করে দিলে। তবুও বিমল সবটা দেখতে পাচ্ছিল না–একে অন্ধকার, গ্রামটাও লম্বায় বড়ো, ওদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে সে জানে না তার সামনে যেগুলি ঘটছে সেগুলি সে কেবল জানে। তবে নারী ও শিশুকণ্ঠের চিৎকার শুনে মনে হচ্ছিল, ওদিকের জাপানি সৈন্যেরা ঠিক বুদ্ধদেবের বাণী আবৃত্তি করছে না। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ এমনি চলল– বেশিক্ষণ ধরে নয়। তখন অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে এসেছে, কেবল জ্বলন্ত ঘরের চালের আলোয় সামনেটা আলোকিত।
হঠাৎ বিমলের যেন হুঁশ হল– সে তার আশে-পাশে চেয়ে দেখলে তার খুব কাছে। কোনো জাপানি সৈন্য নেই–লুঠপাঠের লোভে সবাই গ্রামের ঘর-দোরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে বা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভাবে জটলা করছে।
বিমল একবার পিছনের দিকে চাইলে– সেদিকে একখানা কামানের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ির কাছে সৈন্য নেই। গাড়িখানা থেকে পঞ্চাশ গজ আন্দাজ দূরে একটি প্রাচীন সহমরণের স্মৃতিস্তম্ভ। চীনদেশের অনেক পাড়াগাঁয়ে সহমৃতা বিধবার এমন পুরোনো আমলের স্মৃতিস্তম্ভ সে আরও দু-একটি দেখেছে, ততদূর পর্যন্ত বেশ দেখা যাচ্ছে অগ্নিকান্ডের আলোয়, কিন্তু তার ওপারে অন্ধকার–কিছু দেখা যায় না।
বিমল আস্তে আস্তে পিছনে হটতে হটতে দশ-বারো পা গিয়ে হঠাৎ পেছনে ফিরে ছুট দিয়ে সহমরণের স্মৃতিস্তম্ভটার আড়ালে একটি অন্ধকার স্থানে এসে দাঁড়াল।
ওর বুক ঢিপ ঢিপ করছে, যদি জাপানিরা তাকে এখন ধরে তবে এখুনি গুলি করে মারবে। কিন্তু ওদের হাতে বন্দি হয়ে এভাবে থাকার চেয়ে মৃত্যুপণ করেও মুক্তির চেষ্টা তাকে করতে হবে।
স্মৃতিস্তম্ভটার গায়ে একটা ডোবা। অন্ধকারের মধ্যেও মনে হল ডোবাটায় বেশ জল আছে। বিমল তাড়াতাড়ি ডোবার জলে নামল–তার কেমন মনে হল জলে নেমে সে যদি গলা ডুবিয়ে থাকে, তবেই সব চেয়ে নিরাপদ–ডাঙায় ছুটে পালাবার চেষ্টা করলে বেশিদূর যেতে না-যেতেই সে ধরা পড়বে।
এই ডোবায় নামবার জন্যেই যে এ যাত্রা বেঁচে গেল সেটি সে খানিকটা পরেই বুঝতে পারলে।
অল্পক্ষণ–বোধ হয় দশ-বারো মিনিটের পরেই ভীষণ চিৎকার ও বহু রাইফেলের সম্মিলিত আওয়াজ শোনা গেল। খুব একটা হইচই দুপ দাপ পালানোর শব্দ, আবার চেঁচামেচি–একটা ঘোর বিশৃঙ্খলার ভাব!
বিমল তখন ডোবার জলে গলা ডুবিয়ে বসে আছে। যদি ডাঙায় থাকত তবে অন্ধকারে ছুটন্ত রাইফেলের গুলিতে হয়তো তার প্রাণ যেত।
ব্যাপারটা কী? বিমল দেখলে সেই জাপানি কামানের গাড়িটা ঘিরে একটা খন্ডযুদ্ধ ও হাতাহাতি আরম্ভ হয়েছে সহমরণের স্মৃতিস্তম্ভটার ওপারে। হ্যাঁণ্ডগ্রেনেড ফাটবার ভীষণ আওয়াজে হঠাৎ সমস্ত জায়গাটা যেন কেঁপে উঠল। একটি–দুটি–তিনটি। জাপানি কামানের গাড়ির কাছ থেকে জাপানি সৈন্যেরা হটে যাচ্ছে একটা বাগানের দিকে।