ওপাশ থেকেও তার জবাব আসছে; এটি যে যুদ্ধক্ষেত্র এতক্ষণ পরে বিমল বুঝতে পারলে! ওদিকে চীনা নাইনথ রুট আর্মি জাপানিদের বাধা দিচ্ছে–চীনা সৈন্যবাহিনী সাংহাই ছেড়ে হটে গিয়েছে বটে, কিন্তু জাপানিদের আর এগোতে দেবে না।
আর একটু পরে বিমল লক্ষ করে দেখলে, পাইন বনের একপাশে গাছের তলায় একরাশ মৃতদেহ জাপানি সৈন্যের। স্ট্রেচারে করে বিমলের চোখের সামনে আরও দু-জন মরা কী জ্যান্ত সৈন্যকে নিয়ে এল, বিমল বুঝতে পারলে না। একটু পরে আহতদের আর্তনাদ কানে যেতেই চিকিৎসক বিমল চঞ্চল হয়ে উঠল। পাশের একজন জাপানি সৈন্যকে বললে পিজিন ইংলিশে–আমাকে ওখানে নিয়ে চলো, আমি ডাক্তার, ওদের দেখব।
সব মানুষের দুঃখই সমান। দুঃখপীড়িত মানুষের জাত নেই–তারা চীনা নয়, জাপানিও নয়। একটু পরে জাপানি অফিসারের সম্মতিক্রমে বিমল হতাহত সৈন্যদের কাছে গেল দেখতে, যদি তার দ্বারা কোনো সাহায্য হয়। যদি মড়ার গাদায় জড়ো করা সৈন্যদের মধ্যে দু-একজন সাংঘাতিক আহত লোক বার হয়–কারণ আর্তনাদ সেই গাদার মধ্যে থেকেই আসছিল।
আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বিমলের কিন্তু মনে হচ্ছিল না যে এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র।
বইয়ে পড়া বা কল্পনায় দেখা যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
একটি শান্ত পাইন বন, গোটা তিনেক কামানের গাড়ি, রাইফেল হাতে কতকগুলি সৈন্য উপুড় হয়ে আছে–ওপারে পাহাড়ের ওপর কিছু ধোঁয়া।–
কেবল সম্মুখের হতাহত জাপানি সৈন্যগুলি পরিচয় দিচ্ছে যে বিমল কোনো শান্তিপূর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে নেই যেখানে সে রয়েছে সেখানে মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে সম্পর্ক বড়ো বেশি।
কিন্তু ওষুধপত্র কিছু নেই যা দিয়ে এই সব আহত সৈনিকদের চিকিৎসা চলে। এমনকী খানিকটা আইডিন পর্যন্ত বিমল অনেককে বলেও জোটাতে পারলে না। এদের হাসপাতাল শিবির অনেক দূরে–সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসার কোনো বন্দোবস্ত নেই।
জাপানি সৈন্যেরা কিন্তু দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে পাহাড়ের ওপারে চীনা সৈন্যদের রাইফেল নিস্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। কারণ যে কী, কিছু বুঝলে না।
আবার কামানের গাড়িতে চড়ে সৈন্যবেষ্টিত হয়ে যাত্রা।
এবার জাপানিরা বিমলের সঙ্গে খানিকটা ভালো ব্যবহার করলে, কারণ আহত জাপানি সৈনিকদের ও যথেষ্ট সেবা করেছে। ও যে সাধারণ সৈনিক বা স্পাই নয়, একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার–এই বিশ্বাস জন্মেছে সকলেরই।
পাহাড়ের ওপারে অনেকটা সমতল ক্ষেত্রের মধ্যে একটা ক্ষুদ্র সৈন্যশিবির। ওর মধ্যে ঢুকেই বিমল বুঝতে পারলে, এটা চীনা আর্মির হাসপাতাল–প্রাথমিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিল এখানে–এখন কিছু নেই, চীনা সৈন্য সব সঙ্গে করে নিয়ে পালিয়েছে, কেবল একটা বড়ো দস্তার টব পড়ে আছে–আর কিছু ব্যাণ্ডেজের তুললো। হাসপাতাল শিবির থেকে পঞ্চাশ গজ দুরে এক গাছের তলায় এক চীনা সৈন্যকে পাওয়া গেল–হতভাগ্য গুরুতর আহত। রাইফেলের গুলি বোধ হয় জাপানিদের, তার শরীরের দুই জায়গায় বিধেঁছে–রক্তে তার ইউনিফর্ম ভিজে উঠেছে। একে যে ওর বন্ধুরা কেন শত্রুর হাতে ফেলে পালিয়েছে কিছু বোঝা গেল না।
একজন জাপানি সৈন্য ওর পা ধরে খানিকটা হেঁচড়ে নিয়ে চলল। লোকটার বেশ জ্ঞান রয়েছে–সে যন্ত্রণায় অস্পষ্ট আর্তনাদ করে উঠতেই পেছন থেকে একজন জাপানি অফিসার এগিয়ে গেল তাকে দেখতে।
ওদের মধ্যে উত্তেজিত স্বরে জাপানি ভাষায় কী বলাবলি হল, বিমল বুঝলে না–হঠাৎ অফিসারটি রিভলবার বার করে আহত সৈনিকের মাথায় প্রায় নল ঠেকিয়ে গুলি করলে।
লোকটা যেন রিভলবার ছোঁড়ার সঙ্গেসঙ্গে নেতিয়ে পড়ল। ওর সকল যন্ত্রণার অবসান হয়েছে।
বিমল শিউরে উঠল–চোখের সামনে এ-রকম নিষ্ঠুর হত্যা দেখতে সে এখনও তেমন অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। মাইল তিন দূরে একটা চীনা গ্রাম–যুদ্ধক্ষেত্রের বাঁ-দিক ঘেঁষে। ডান দিকে একটি অনুচ্চ পাহাড়শ্রেণির দিকে জাপানি অফিসারটির ফিল্ড গ্লাস দিয়ে দেখছে সবাই, সেদিকে আঙুল দিয়ে কী দেখাচ্ছে–বিমল বুঝলে ওই পাহাড়টা বর্তমানে চীনা নাইনথ রুট আর্মির দ্বিতীয় ঘাঁটি। প্রথম ঘাঁটি ছিল পূর্বোক্ত পাইন বনের সামনের পাহাড়ে–তা গিয়েছে।
একস্থানে একদল জাপানি সৈন্য গোল হয়ে দাঁড়িয়ে জটলা করছে। তাদের পাশ দিয়ে বিমলদের দল কামানের গাড়ি নিয়ে চলে গেল। ওরা যেন খুব উত্তেজিত হয়ে কী বলাবলি করছে, বিমল বুঝতে পারলে না। একজন পিজিন ইংলিশ জানা জাপানি সৈন্যকে জিজ্ঞেস করলে…ওখানে কী হচ্ছে? সৈন্যটি বললে– শোনোনি তুমি? সাংহাই শহর এখন আমাদের হাতে। আজ সকালে আমাদের হাতে এসেছে।
অত বড়ো সাংহাই শহর তোমাদের হাতে সবটা এসেছে?
সব। ওরা এইমাত্র ফিল্ড টেলিফোনে খবর পেয়েছে।
যুদ্ধ হল কখন?
কাল সারারাত প্রায় দু-শো বহুবার প্লেন বোমা ফেলেছে–শুনছি বিস্তর লোক মরেছে। সাংহাইতে–
সকলেই সাধারণ নাগরিক বোধ হয়?
বেশিরভাগ। হাজার দুই তো শুধু চা-পেইতেই মরেছে–আর শুনছি কনসেশনে বোমা ফেলে ছ-শো পলাতক চীনাকে মারা হয়েছে। ভয়ানক যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে–হবেই তো– আমাদের বাধা দেবার কেউ নেই। সাংহাই কী, সারা এশিয়া আমরা দখল করব–তোমাদের ভারতবর্ষ তো বটেই। দেখে নিও তুমি–নাও, এগিয়ে চলো।
বিমল ভাবছিল সুরেশ্বর কী বেঁচে আছে। বোধ হয় না। চা-পেই পল্লির অত্যন্ত কাছে চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউতে চীনা রেডক্রস হাসপাতাল। জাপানি বম্বারগুলির বিশেষ দৃষ্টি হাসপাতালের ওপর। কাল রাত্রেই সুরেশ্বরের ডিউটি থাকবার কথা। সম্ভবত হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়েছে– রোগী, ডাক্তার, নার্সসুদ্ধ। ভাগ্যে এ্যালিস আর মিনি ওখানে ছিল না!