তারপরই বিমল দেওয়ালের দিকে চেয়ে দেখলে চীনা দু-টি উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। দু জন জাপানি সৈন্য তাদের মৃতদেহের পা ধরে হিঁচড়ে টেনে একপাশে রেখে দিলে। তারা পাশাপাশি পড়ে রইল এমন ভাবে, দেখে বিমলের মনে হল ওরা কোনো ঠাকুরের সামনে উপুড় হয়ে প্রণাম করছে।
মানুষকে মানুষ যে এমন ভাবে হত্যা করতে পারে, বিমল তা আজ প্রথম দেখেছে হাসপাতালে, আর দেখলে এখন।
এবার বিমলের পালা, বিমল ভাবলে।
কিন্তু চেয়ে দেখলে আর চারজন চীনাকে আবার কোথা থেকে নিয়ে এসে জাপানি সৈন্যেরা টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
এবারও পূর্বের মতো কথা-কাটাকাটি হল জাপানি অফিসার ও সৈন্যদলের মধ্যে।
তারপর আবার পূর্বের ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি! এই চীনা চারজনও উপুড় হয়ে পড়ল দেয়ালের সামনে আগের দু-জনের মতো।
চীনা ভাষা যদিও-বা কিছু কিছু শিখেছে বিমল, জাপানি ভাষার তো সে বিন্দুবিসর্গ জানে । কেন যে এদের গুলি করে মারা হচ্ছে, কী অপরাধে এরা অপরাধী, কিছু বোঝা গেল না। আর এখানে জাপানিরাই কথাবার্তা বলছে, চীনাদের বিশেষ কিছু বলবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
বিমল ভাবছিল–এই দূর বিদেশে এখনি তার প্রাণ বেরোবে। মা-বাবার সঙ্গে আর দেখা হল না, হয়তো তাঁরা জানতেও পারবেন না যে তার কী হয়েছে। শুধু একখানা চিঠি যাবে তাঁদের কাছে, তাতে লেখা থাকবে, ছেলে তাঁদের মিসিং–খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!… কিন্তু এ্যালিসের কী হল! এ্যালিসের সঙ্গেও আর দেখা হবে না। এ্যালিসকে বড়ো ভালো লেগেছিল। কোথায় যে তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে! বেচারি এ্যালিস! বেচারি মিনি!
কিন্তু বিমলের পালা আসতে বড়ো দেরি হতে লাগল।
দলে দলে চীনা নাগরিকদের টেবিলের সামনে দাঁড় করানো চলতে লাগল। তারপর তাদের হত্যা করাও সমানভাবে চলছে।
মৃতদেহ ক্রমেই স্থূপাকার হয়ে উঠছে।
এ-রকম নিষ্ঠুর হত্যা-দৃশ্য আর দেখা যায় না চোখে।
বিমলকে এইবার দু-জন জাপানি সৈন্য নিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে। বিমল অনুভব করলে তার ভয় হচ্ছে না মনে–কিন্তু একটা জিনিস হচ্ছে।
জ্বর আসবার আগে যেমন গা বমি-বমি করে, ওর ঠিক তেমনি হচ্ছে শরীরের মধ্যে। মাথাটা যেন হঠাৎ বড়ো হালকা হয়ে গিয়েছে, আর কেমন যেন বমির ভাব হচ্ছে।
জাপানি সামরিক অফিসারটি ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলে–তুমি রাস্তায় কী করছিলে?
বিমল ইংরেজিতে বললে রাস্তায় সে কিছু করেনি। হাসপাতাল থেকে তাকে ধরে এনেছে।
কোন হাসপাতাল?
চীনা রেডক্রস হাসপাতাল?
তুমি সেখানে কী করছিলে?
আমি ডাক্তার। ডিউটিতে ছিলাম, জপানি সৈন্যেরা একজন চীনা রোগীকে অকারণে বেওনেটের খোঁচায়–
পেছন থেকে দু-জন জাপানি সৈন্য ওকে রুক্ষ স্বরে কী বললে, বিমলের মনে হল তাকে চুপ করে থাকতে বলছে।
জাপানি অফিসারটি বললে–থামলে কেন? বলে যাও—
বিমল হাসপাতালের হত্যাকান্ডের কথা সংক্ষেপে বলে গেল।
জাপানি অফিসার চারিপাশের জাপানি সৈন্যদের দিকে চেয়ে জাপানি ভাষায় কী প্রশ্ন করলে। বিমলের দিকে চেয়ে বললে–তুমি সেই সৈন্যকে চিনতে পারবে?
না। অত ভালো করে দেখিনি তার চেহারা, তখন মাথার ঠিক ছিল না, তা ছাড়া জাপানি সৈন্যেরা সবাই আমার চোখে একই রকম দেখায়। দেখতে অভ্যস্ত নই বলে।
তুমি সিঙ্গাপুরের লোক?
আমি ভারতবাসী।
চীনা হাসপাতালে চাকুরি কর?
হ্যাঁ।
সরাসরি এসেছ চীনে?
এ প্রশ্ন করবার কারণ বিমল একটু একটু বুঝতে পারলে। এখানে সে একটা মিথ্যে কথা বললে। এই একমাত্র ফাঁক, এই ফাঁক দিয়ে সে এবারের মতো গলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা তো করবে। তারপর যা হয় হবে। সে বললে–সরাসরি আসিনি। আন্তর্জাতিক কনসেশনে এসেছিলাম; ব্রিটিশ কনসুলেট অফিসে আমার নাম রেজেস্ট্রি করা আছে।
এই সময় একজন জাপানি সৈন্য কী বললে অফিসারটিকে। তার হাতে তিনটে জরির ব্যাণ্ড, দেখে মনে হয় সে একজন করপোরাল কিংবা কম্প্যানি কমাণ্ডার।
জাপানি অফিসার বিমলের দিকে কুটি করে বললে–তুমি একজন গুপ্তচর।
আমি একথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছি। আমি ডাক্তার। তোমার সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই জানে আমি হাসপাতালে ডিউটিতে ছিলাম, ওরা ধরে এনেছে।
আঙুলের টিপসই দাও দু-টি এখানে।
বিমল দু-খানা কাগজে টিপসই দিলে। তারপর জাপানি অফিসার কী আদেশ করলে জাপানি ভাষায়, ওকে দু-জন জাপানি সৈন্য ধরে নিয়ে গিয়ে বাইরে একটা কামানের গাড়ির ওপর বসালে। চারিধারে বহু জাপানি সৈন্য গিজ গিজ করছে। সকলেই ব্যস্ত, উত্তেজিত। কোথায় যাবার জন্য সকলেই যেন ব্যগ্র উৎসুক।
বিমল দেখলে তাকে এরা ছেড়ে দিলে না। মুক্তি যে দিয়েছে তা নয়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে? জাপানি ভাষার সে বিন্দুবিসর্গ বোঝে না, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারে । মিনিট পনেরোর মধ্যে ঘড় ঘড় করে কামানের গাড়ি টানতে লাগল একখানা মোটর লরি। ওর দু-দিকে সাঁজোয়া গাড়ি চলেছে সারি দিয়ে।
সাংহাই অতি প্রকান্ড শহর, এর আর যেন শেষ নেই, ঘণ্টা দুই চলবার পরে শহরের বাড়ি-ঘর ক্রমে কমে আসতে লাগল। ফাঁকা মাঠ আর ধানের খেত। চীনদেশের এ অংশের দৃশ্য ঠিক যেন বাংলা দেশ, তবে এখানে কাছাকাছি নীচু পাহাড়শ্রেণি চোখে পড়ে।
কিছুদূরে একটা অনুচ্চ পাহাড়ের ওপারে ঘন ধোঁয়া। রাইফেল ছোঁড়ার শব্দ আসছে।
এক জায়গায় মাঠের মধ্যে পাইন বন। সেখানে কামানের গাড়ি দাঁড়াল। বিমল দেখলে একটি উঁচু ঢালু মতো জায়গা লম্বা সারি দিয়ে জাপানি সৈন্যরা উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেল ধরে ছুড়ছে, এক সঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটটা রাইফেলের আওয়াজ হচ্ছে।