প্রোফেসর লি বললেন–কত লোক পালাচ্ছিল?
তা বোধ হয় দশ হাজারের কম নয়। অর্ধেক সাংহাই ভেঙে মেয়ে-পুরুষ সব পালাচ্ছে কনসেশনের দিকে। আপনারা সব চলুন, একটু বোঝান ওদের। রাত্রির ব্যাপারে সব ভয় খেয়েছে বড়।
কনসেশনের পুলিশদলকে চলে যেতে উদ্যত দেখে বিমল বললে–আজই মেয়ে দুটির ব্যবস্থা আপনাদের করতে হবে– দেরি হলে ওদের খুঁজে বার করা শক্ত হবে হয়তো।
চীনা পুলিশের ডেপুটি মার্শাল বললেন–সে-বিষয়ে ওঁরা কিছু সাহায্য করতে পারবেন । বদমাইশদের লিস্ট আমাদের কাছে আছে। আমি আজ এখুনি এর ব্যবস্থা করছি। ব্যস্ত হবেন না– বিদেশি গভর্নমেন্টের কাছে এজন্যে আমাদের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি।
সেদিন সারাদিন ওরা হাসপাতালে গেল না। ডাক্তার সাহেবকে জানিয়ে দিলে মিনি ও এ্যালিসের বিপদের কথা। কনসেশনে যাবার জন্যে দু-বার চেষ্টা করেও কৃতকার্য হল না। সে-পথ লোকজনের ভিড়ে বন্ধ হয়ে আছে, তা ছাড়া ইয়াং সিকিয়াংয়ের পুলের ওপারের মুখে মেশিনগান বসানো।
সারাদিন ধরে কী করুণ দৃশ্য সাংহাইয়ের বাইরের বড়ো বড়ো রাজপথগুলিতে! লোকজন মোট-পুঁটুলি নিয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে–সাংহাই থেকে যোনান যাবার রাজপথ পলাতক নর-নারীতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ভয়ানক গরমে এই ভিড়ে অনেকে সর্দি-গর্মি হয়ে মারাও পড়ছে।
দু-খানা হাসপাতালের গাড়ি ওদের সাহায্যের জন্য পাঠানো হয়েছিল কিন্তু ভিড় ঠেলে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব দেখে গাড়ি দুখানা শহরের উপকণ্ঠে এক জায়গায় পথের ধারেই দাঁড়িয়ে রইল। একখানা গাড়ির চার্জ নিয়ে বিমল সেখানে রয়ে গেল। সুরেশ্বর রইল তার সহকর্মী হিসেবে।
শীঘ্রই কিন্তু কী ভয়ানক বিপদে পড়ে গেল দু-জনেই। ওরা অনেকক্ষণ থেকেই ভাবছিল এই ভীষণ ভিড়ের মধ্যে জাপানি প্লেন যদি বোমা ফেলে তবে যে কী কান্ড হবে তা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়।
বেলা দুটো বেজেছে। একজন তরুণ চীনা সামরিক কর্মচারী মোটরবাইকে সাংহাইয়ের দিক থেকে এসে ওদের অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির সামনে নামল। বললে–আপনারা এখান থেকে সরে যান–
বিমল বললে– কেন?
জাপানি সৈন্য শহরের বড়ো পাঁচিল ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে–এখনও দুটো পাঁচিল বাকি–কিন্তু সন্ধ্যার মধ্যে ওরা সমুদ্রের ধারে সমস্ত দিকটা দখল করবে। আর আমরা খবর পেয়েছি পঞ্চাশখানা বোমারু প্লেন একঘণ্টার মধ্যে শহরের ওপর আবার বোমা ফেলবে।
এই লোকগুলির অবস্থা তখন কী হবে?
চীনের মহাদুর্ভাগ্য, স্যার। আপনারা বিদেশি, আপনাদের প্রাণ আমরা বিপন্ন হতে দেব না। আমরা মরি তাতে ক্ষতি নেই। অপনারা সরে যান এখান থেকে।
একটি গাছের তলায় একটি বৃদ্ধা বসে। সঙ্গে একটা পুঁটুলি, গোটা কতক মাটির হাঁড়ি কুঁড়ি। মুখে অসহায় আতঙ্কের চিহ্ন।
সামরিক কর্মচারীটি কাছে গিয়ে বললে– কোথায় যাবে?
বৃদ্ধা ভয়ে ভয়ে সৈনিকটির দিকে চাইল কিন্তু চুপ করে রইল। উত্তর দিলে না। সৈনিকটি আবার জিজ্ঞেস করলে– কোথায় যাবে তুমি? তোমার সঙ্গে কে আছে?
এবারও বুড়ি কিছু বললে না।
বিমল বললে–বোধ হয় কানে শুনতে পায় না। দেখছ না ওর বয়েস অনেক হয়েছে। চেঁচিয়ে বলো।
তরুণ সামরিক কর্মচারী বৃদ্ধার নাতির বয়সি। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিৎকার করে বললে–ও দিদিমা, কোথায় যাচ্ছ?
বুড়ি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে–কোথায় আর যাব? সবাই যেখানে যাচ্ছে।
এখানে বসে থেকো না। বোমা পড়বে এক্ষুনি। সঙ্গে কেউ নেই?
বোমার কথা শুনেই বুড়ি ভয়ে আড়ষ্ট হল, ওপরের দিকে চাইলে। বললে–আমি আর হাঁটতে পারছি না, আমার আর কেউ নেই, আমাকে তোমরা একখানা গাড়ির ওপর উঠিয়ে দাও।
বিমল বললে–আমি ওকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিচ্ছি। বড় বয়েস হয়েছে, এতখানি পথ ছুটোছুটি করে এসে হাঁপিয়ে পড়েছে।
দু-জনে ওকে ধরাধরি করে গাড়িতে এনে ওঠালে।
এক জায়গায় একটি গৃহস্থ পরিবারের ঠিক এই অবস্থা। গৃহিণীর বয়েস প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ, সাত আটটি ছেলে-মেয়ে, সকলের ছোটোটি দুগ্ধপোষ্য শিশু, বাকি সব দুই, চার, পাঁচ, সাত এমনি বয়েসের। সঙ্গে একটিও পুরুষ নেই। ওরাও হাঁটতে না পেরে বসে পড়েছে।
জিজ্ঞেস করে জানা গেল বাড়ির কর্তা জাহাজে কাজ করেন–জাহাজ আজ কুড়ি দিন হল বন্দর থেকে ছেড়ে গিয়েছে। এদিকে এই বিপদ! কাজেই মা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন বাড়ি থেকে কোথায় যাবেন ঠিক নেই।
এদের অসহায় অবস্থা দেখে বিমলের খুব কষ্ট হল। কিন্তু তার কিছু করবার নেই। কত লোককে সে হাসপাতাল গাড়িতে জায়গা দেবে?
সে-দিন শহরের এমন ভয়ানক অবস্থা গেল যে কে কার খোঁজ রাখে! মিনি ও এ্যালিসের উদ্ধারের কোনো চেষ্টাই হল না। সারা দিনরাত এমনি করে কাটল।
রাত্রি শেষে জাপানি নৌসেনা সাংহাই শহরের দক্ষিণ অংশ অধিকার করলে। বিমল ও সুরেশ্বর তখন হাসপাতালে। ওরা কিছুই জানত না। তবে ওরা এটুকু বুঝেছিল যে অবস্থা গুরুতর। সারারাত্রি ধরে জাপানি যুদ্ধ-জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করলে। বোমারু প্লেনগুলির তেমন আর দেখা নেই, কারণ শহর প্রায় জনশূন্য। পথে-ঘাটে লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে।
রাত তিনটে। এমন সময় ওয়ার্ডের মধ্যে কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য ঢুকতে দেখে বিমল প্রথমটা বিস্মিত হল; তারপরই ওর মনে হল এরা চীনা নয়, জাপানি সৈন্য। ক্রমে পিলপিল করে বিশ ত্রিশজন জাপানি সৈন্য হাসপাতালের বড়ো হলটার মধ্যে ঢুকল। চারিদিকে শোরগোল শোনা গেল। রোগীর দল অধিকাংশই বোমায় আহত নাগরিক, তারা ভয়ে কাঠ হয়ে রইল জাপানি সৈন্য দেখে।