একদল লোককে দেখা গেল ভাঙা বাড়িগুলো থেকে জিনিসপত্র, মৃতদেহ টেনে বার করছে। ওরা টর্চ জ্বেলে টর্চের মুখ নীচের দিকে নামিয়ে মৃতদেহ কী জ্যান্ত মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে, পাছে ওপর থেকে বোমারু প্লেনগুলি টের পায়।
বিমল তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলে। সাগ্রহে সে ছুটে গেল– প্রোফেসর লি, প্রোফেসর লি–
অন্ধকারের মধ্যে বিমলকে উনি চিনলেন। বললেন–আমি আমার ছাত্রের দল নিয়ে বেরিয়েছি, দেখি যদি কিছু করতে পারি। আমার মেয়েরা কোথায়?
এই সৌম্যদর্শন, পরহিতব্রতী বৃদ্ধের স্নেহ-সম্ভাষণে বিমলের মন আদ্র হয়ে উঠল। বললে –সে অনেক কথা। আমার মনে হয় আপনি এবং আপনার দলই এ বিষয়ে আমায় সাহায্য করতে পারবেন।
প্রোফেসর লি হাসিমুখে বললেন–যুদ্ধের সময়কার মনস্তত্ত্ব আলোচনা করতে এসেছিলুম জানেন তো? এর চেয়ে উপযুক্ত ক্ষেত্র আর কোথায় পাব সে আলোচনার?
হঠাৎ একটা প্লেন মাথার ওপর এল। সবাই কথা বন্ধ করে ওপর দিকে চাইলে।
মার্কিন পুলিশম্যানটি চেঁচিয়ে উঠল–কভার! কভার!
কোথায় আর আশ্রয় নেবে, সেই ভাঙা বাড়ির ইটকাঠের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা ছাড়া সবাই সেই দিকে ছুটল। বিমলও চীনা খুকিটার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল সেই দিকে।
প্লেন থেকে বোমা পড়ল না। পড়ল কতকগুলি চকচকে রুপোর বাতিদানের মতো লম্বা লম্বা জিনিস। প্লেনটা চলে গেলে ওরা সেগুলি দূর থেকে ভয়ে ভয়ে দেখলে। সরু সরু রুপোর নলের মতো জিনিস, হাতখানেক লম্বা। ঝকঝকে সাদা। মার্কিন পুলিশম্যান একটা হাতে তুলে নিয়ে বললে–ইনসেনডিয়ারি বম্ব–আগুন লাগাবার বোমা–অ্যালুমিনিয়ম আর ইলেকট্রনের খোল, ভেতরে অ্যালুমিনিয়ম পাউডার আর আয়রন অক্সাইড ভরতি। এই দেখো ছ-টা করে ফুটো টিউবের গোড়ার দিকে। এই দিয়ে আগুনের ফুলকি বার হয়ে আসবে। এ আগুন নিবানো যায় না।
জাপানিদের মতলব এবার স্পষ্ট বোঝা গেল। হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা ফেলবার পর লোকজন ভয়ে দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পালাবে, তখন ওরা শহরে ইনসেনডিয়ারি বম্ব ফেলে আগুন লাগিয়ে দেবে, আগুন নিবোতে কে এগোবে তখন!
কী ভীষণ ধ্বংসের আয়োজন! বিমল সেই ঝকঝকে পালিশ করা সরু টিউবটা হাতে নিয়ে শিউরে উঠল। এই টিউবের মধ্যে সুপ্ত অগ্নিদেব এখুনি জেগে উঠে এই এত বড়ো সাংহাই শহরটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবে, তারই আয়োজন চলছে।
মার্কিন পুলিশম্যানটি বললে–পঁয়ষট্টি গ্রাম অ্যালুমিনিয়াম পাউডার আর পঁয়ত্রিশ গ্রাম আয়রন অক্সাইড। আমাদের মার্কিন নৌবহরের উড়োজাহাজে আজকাল এর চেয়েও ভালো বোমা তৈরি হচ্ছে–আয়রন অক্সাইডের বদলে দিচ্ছে—
কাছেই আরও দু-তিনটে রুপোর বাতিদান পড়ল।
৪. ধুলো কাদা মাখা চেহারা
দিনের বেলায় ওরা পরস্পরের ধুলো কাদা মাখা চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল। প্রোফেসর লি তখনও কাজে ব্যস্ত, চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে লোকজন টেনে বার করে বেড়াচ্ছেন, তিনি আর তাঁর ছাত্রেরা। পুলিশও এসেছে, দুটো রেডক্রসের হাসপাতাল গাড়িও এসেছে। আকাশে জাপানি বোমারু প্লেনগুলির চিহ্ন নেই।
রাত্রিটা কেটে গিয়েছে যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো। বেলা এখন দশটা–এখনও সে দুঃস্বপ্নের জের মেটেনি! বিনা কারণে এমন নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলার তান্ডব যে চলতে পারে তা এর আগে, ভারতবর্ষে থাকতে বিমল কখনো ভেবেছিল?
কনসেশনে সেই সবজান্তা আমেরিকান পুলিশটা বলছিল–দেখবেন ওরা ইনসেনডিয়ারি বোমা ফেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে। এখানে অনেক বাড়িই কাঠের। তাতে আবার বোমার আগুন জলে নেবে না। বালি ছড়াতে হয় একরকম কল দিয়ে। প্রথম অবস্থায় বোমাটাকে বালি বোঝাই থলে দিয়ে চেপে ধরলেও আর স্পার্ক ছোটে না–কিন্তু সেসব করে কে?
চীনা পুলিশের ডেপুটি মার্শাল বললেন–কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেখা যাচ্ছে হাই এক্সপ্লোসিভ বোমায়। কাল সন্ধ্যা ও রাতের বোমা ফেলার দরুন চা-পেই পাড়া ও সাংহাইয়ের চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউতে সাত-আট-শো বাড়ির চিহ্ন নেই–মানুষ মারা পড়েছে তিন-শোর ওপর, মেয়ে-পুরুষ মিলিয়ে। জখম হয়ে হাসপাতালে গিয়েছে প্রায় পাঁচ শো। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বাঁচবার আশা নেই।
প্রোফেসর লি বললেন–আমাদের সবচেয়ে ভীষণ শত্রু যে এই বোমারু প্লেনগুলি, তা ক দিনের ব্যাপারে আমরা বুঝতে পারছি। তবুও তো এখনো ওরা সমবেতভাবে আক্রমণ করেনি–করলেও এক-শোখানা প্লেনের প্রত্যেক প্লেনখানা থেকে দু-টন বোমা ফেললে পাঁচ হাজার লোক কালই মেরে ফেলত।
সবজান্তা পুলিশম্যানটি বললে–জাপানি বম্বারগুলি এক-একখানা দু-টন বোমা বইতে পারে না মশায়– সে পারে জার্মান ডর্নিয়ের কিংবা ইটালির কাপ্রোনি—কিংবা–
ডেপুটি মার্শাল বললেন–আহা হা, ও সব এখন থাক–ও তর্কে কী লাভ আছে? এখন আমাদের দেখতে হবে যে দু-টি মার্কিন মহিলাকে কাল রাত্রে গুন্ডারা নিয়ে গিয়েছে, তাঁদের উদ্ধারের কী উপায় করা যায়, বোমা এখন এবেলা অন্তত আর পড়বে না–
এমন সময়ে একজন চীনা পুলিশ সার্জেন্ট মোটর সাইকেলে ছুটে এসে সংবাদ দিলে, কনসেশন অঞ্চলে চীনা পলাতক নর-নারীদের সঙ্গে কনসেশন পুলিশের ভয়ানক দাঙ্গা আরম্ভ হয়েছে। ওরা ইয়াং সিকিয়াং-এর ব্রিজ পার হয়ে যাচ্ছিল, কনসেশন পুলিশ ব্রিজের ওমুখে মেশিনগান বসিয়েছে–তারা বলছে এত পলাতক লোক জায়গা দেবার স্থান নেই কনসেশনে। খাবার নেই, জল নেই। গেলে সেখানে দুর্ভিক্ষ হবে।