বিমল লাফ দিয়ে রিকশাওয়ালার ঘাড়ে পড়ল রিকশা থেকে। রিকশাখানা উলটে গেল সঙ্গেসঙ্গে। সুরেশ্বর রিকশার সঙ্গে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল। রিকশাওয়ালাটা সেখানে বসে পড়ল–ওর ওপর বিমল!
রিকশাওয়ালটা একটু পরেই গা ঝেড়ে উঠে, চীনা ভাষায় কী একটি দুর্বোধ্য কথা বলে উঠে, ওদের দিকে এগিয়ে এল।
বিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল–সুরেশ্বর, সাবধান!
রিকশাওয়ালার হাতে একখানা বড়ো চকচকে ছোরা দেখা গেল।
সুরেশ্বর পেছন থেকে তাকে জোরে এক ধাক্কা লাগালে, সে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আবার বিমলেরই উপর। বিমলের সঙ্গে তার ভীষণ ধস্তাধ্বস্তি শুরু হল। বিমলের রীতিমতো শরীরচর্চা করা ছিল। মিনিট পাঁচ-ছয়ের মধ্যে রিকশাওয়ালাকে মাটিতে ফেলে, বিমল তার হাত মুচড়ে ছোরাখানা টান দিয়ে ফেলে বললে–ওখানা তুলে নাও সুরেশ্বর–তারপর এই বদমাইশটার গলায় বসিয়ে দাও–
ছোরা হাত থেকে খসে যাওয়াতে বদমাইশটা নিরুৎসাহ ও ভীত হয়ে পড়ল–এইবার ছোরা বসানোর কথা শুনে, সে বিমলের কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিলে। সব ব্যাপারটা ঘটে গেল পাঁচ-ছ-মিনিটের মধ্যে।
বিমল ঝেড়ে উঠে একটু দম নিয়ে বললে–সুরেশ্বর, মেয়েদের গাড়িখানা!
তারপর ওরা দু-জনেই ছুটল সেই গলিটার দিকে–যেটার মধ্যে মিনিদের রিকশাখানা ঢুকেছে। গলিটা নিতান্ত নোংরা, দু-ধারে কাঁচা টালির ছাদওয়ালা নীচু নীচু বাড়ি–কিছুদূরে একটি সাধারণ স্নানাগার–এখানে নীচশ্রেণির মেয়ে-পুরুষে সাধারণত স্নান করে না– করলেও রাত্রে করে। স্নানাগারের সামনে দু-জন চীনেম্যান দাঁড়িয়ে আছে দেখে, বিমল তাদের পিজিন ইংলিশে জিজ্ঞেস করলে–একখানা রিকশা কোন দিকে গেল দেখেছ?
তাদের মধ্যে একজন বললে–এই বাড়িটার সামনে একখানা রিকশা দাঁড়িয়েছিল একটু আগে।
বিমল ও সুরেশ্বর বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকাডাকি করেও কারো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন বিমল বললে–চলো বাড়ির মধ্যে ঢুকি–
ঘরটা ঢুকেই ওদের মনে হল, এটা একটা চড়ুর আড্ডা। ঘরের মধ্যে চার-পাঁচটা চীনা বাঁশের চেয়ার, একদিকে একটি নীচু বাঁশের তক্তাপোশ। চন্ডু খাবার লম্বা নল, ছিটেগুলি গালার বড়ো পাত্রে, চন্ডুর আড্ডার সব জিনিসই মজুদ। দেওয়ালে চীনা দেবতার ভীষণ প্রতিকৃতি। ঘরটি লোকশূন্য, নির্জন। এ ধরনের চড়ুর আজ্ঞা ওরা সিঙ্গাপুরে দেখেছে! কিন্তু বাড়ির লোকজন কোথায়? বিমল ও সুরেশ্বর বাড়িটার মধ্যে ঢুকে গেল।
একটা বড়ো ঘরের মধ্যে অনেকগুলি লোক বসে মা জং খেলছে। বিমল বুঝতে পারলে, জায়গাটা শুধু চন্ডু নয়, নীচু শ্রেণির জুয়াড়িদের আড্ডাও বটে। ওদের দেখে দু-জন লোক উঠে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে একজন কর্কশ কন্ঠে পিজিন ইংলিশে বললে–কী চাই? কে তোমরা? বিমলের মাথায় চট করে এক বুদ্ধি খেলে গেল। সে কর্তৃত্বের গ্রাম-ভারি চালে বললে, আমরা ব্রিটিশ কনসেশনের পুলিশের লোক। আমাদের সঙ্গে দশজন কনস্টেবল গলির মোড়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের সঙ্গে বন্দুক ও রিভলবার আছে! দু-জন মেমসাহেবকে এই আড্ডায় গুম করা হয়েছে–বার করে দাও, নইলে আমরা জোর করে ভেতরে ঢুকে সন্ধান করব। দরকার হলে গুলি চালাব।
এবার একজন প্রৌঢ় লম্বা ধরনের লোক এককোণ থেকে বলে উঠল–আমরা কনসেশনের পুলিশ মানি নে–সাংহাইয়ের পুলিশ মার্শালের সই করা ওয়ারেন্ট দেখাও
বিমল বললে–তুমি জান এটা যুদ্ধের সময়। আমরা জোর করে ঢুকব এবং দরকার হলে এই মা জং-এর জুয়ার আড্ডার প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে সাংহাই পুলিশের হাতে দেব-এর জন্যে যদি কোনো কৈফিয়ৎ দিতে হয় পুলিশ মার্শালের কাছে আমরা দেব–তুমি মেম সাহেবদের বার করে দেবে কিনা বলো—
লোকটা বললে কোন মেমসাহেবের কথা বলছ? মেমসাহেবের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ কী? আমি ভাবছিলুম, তুমি জুয়া আর চড়ুর আড্ডা হিসেবে বাড়ি সার্চ করবে বলছ।
বিমল বললে–বেশি কথায় সময় নষ্ট করতে চাইনে–তাহলে আমাদের জোর করতে হল–সুরেশ্বর কনস্টেবলদের ডাকো–
হঠাৎ চিৎকার করে সে বলে উঠল–মাথা নীচু করে বসে পড়ো–বসে পড়ো সুরেশ।
সাঁ করে একটা শব্দ হল এবং ঝকঝকে কী একটা জিনিস ওদের চোখের সামনে এক ঝলক খেলে গেল–ওরা তখন দু-জনেই বসে পড়েছে। সঙ্গেসঙ্গে ওদের পেছনের দেওয়ালে একটা ভারি জিনিস ঠক করে লাগবার শব্দ হল।
সুরেশ্বর পেছন ফিরে চকিতে চেয়ে দেখলে–একখানা বাঁকা ধারালো চকচকে চীনে ছোরা, ছুঁড়ে-মারা ছোরা, ছুঁড়ে মারবার জন্যেই এগুলি ব্যবহৃত হয়– ছোরাখানা সবেগে দেওয়ালে প্রতিহত হয়ে, আধখানা ফলাসুদ্ধ দেওয়ালের গায়ে গেঁথে গিয়েছে।
সুরেশ্বর শিউরে উঠল–ওরই গলা লক্ষ করে ছোরাখানা ছোড়া হয়েছিল।
ওদের সঙ্গে সত্যিই হাতাহাতি বাধলে বা সবাই একযোগে আক্রমণ করলে নিরস্ত্র বিমল ও সুরেশের কী দশা হত বলা যায় না, কিন্তু বিমল মাটি থেকে উঠেই দেখলে ঘরের মধ্যে আর একজন লোকও নেই।
পালায়নি–হয়তো-বা ওরা লোক ডাকতে গিয়েছে! সুরেশ্বর নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে, খানিকটা দিশাহার হয়ে পড়েছিল। বিমল গিয়ে তার হাত ধরে টেনে তুলে বললে–সুরেশ্বর, এই বেলা উঠে বাড়িটা খুঁজি এসো–এখুনি সব চলে আসতে পারে। একটা ঘর বন্ধ ছিল–বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আর সব ঘর খোলা–সেগুলি জনশূন্য। সুরেশ্বর ও বিমল দু-জনেই একযোগে ঘরের দরজায় লাথি মারতে লাগল।