মিনি হঠাৎ আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে দেখিয়ে বললে–ওই দেখো, দেখো—
তিনখানা চীনা এরোপ্লেন তিন দিকে জাপানি বম্বরখানাকে তাড়া করছে। একখানা চীনা প্লেন বম্বারখানার খুব কাছে এসে পড়েছে–একটু পরেই সেখান থেকে মেশিনগানের পট পট আওয়াজ শোনা গেল–পেছনের আর একখানা চীনা সাহায্যকারী প্লেন ওদের ওপরে নীলাভ তীব্র সার্চলাইট ফেলতেই জাপানি বম্বরখানা বেশ স্পষ্ট দেখা গেল।
ততক্ষণ সবাই আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে উঁকি মেরে আকাশের দিকে চেয়ে ব্যাপারটা দেখছে। আরও দু-জন চীনা খদ্দের অন্য টেবিলে চা খেতে বসে গেল। দোকানি স্ত্রীলোকটি তাদের খাবার দিলে। মিনি তাদের টেবিলের দিকে চেয়ে বললে–ওই ওরা ব্যাঙের স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছে–
মেশিনগানের আওয়াজ তখন বড়ো বেড়েছে। জাপানি প্লেনখানা পাক দিয়ে ঘুরছে। হঠাৎ পালাবে না।
বিমল বললে–না; একটু নিরিবিলি চা খেতে এলাম আর অমনি মাথার ওপরে চীন জাপানের যুদ্ধ বেধে গেল–পোড়া বরাত এমনি–
একজন ফিরিওয়ালা এসে শামিয়ানার বাইরে দাঁড়িয়ে বললে– মোমের ফুল–খুব চমৎকার মোমের ফুল গোলাপ, ক্রিসেনথিমাম, গাঁদা–ভারি সস্তা মোমের ফুল–
এমন সময়ে একজন খবরের কাগজওয়ালা সাংহাই ডেলি নিউজ বলে হেঁকে যাচ্ছে দেখে বিমল ডেকে একখানা কাগজ কিনলে। এ কাগজের একদিকে চীনা ভাষায় অন্য দিকে ইংরেজি ভাষায় লেখা খবর–চীনাদের পরিচালিত।
রাস্তায় লোক ভিড় করে কাগজ কিনছে, কাগজ এইমাত্র বেরিয়েছে, এ বেলায় যুদ্ধের খবর নিয়ে সবাই–যুদ্ধের খবর জানতে চায়।
এ্যালিস বললে–যুদ্ধের খবর কী?
তারপর সবাই মিলে ঝুঁকে পড়ে কাগজখানা পড়ে দেখতে লাগল। শেনসু প্রাচীরের কাছে জাপানি সৈন্য চীনাদের কাছে ধাক্কা খেয়ে হটে গিয়েছে। জাপানিদের বহু সৈন্য মারা পড়েছে।
সুরেশ্বর বললে–সর্বৈব মিথ্যা। জাপানিরা জিতছে। ভুল খবর দিচ্ছে আমাদের, পাছে শহরে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। দেখছ না বোমা ফেলবার কান্ড? চীনারা জিতছে! ফু:–
ওদের অত্যন্ত আশ্চর্য মনে হল, মাত্র তিন মাইল দূরে শেনসু প্রাচীরের কাছে যুদ্ধ চলছে, অথচ ওদের খবরের কাগজ পড়ে জানতে হচ্ছে যুদ্ধের ফলাফল, যেমন কলকাতায় বসে বা আমেরিকায় বসে লোকে জেনে থাকে। তিন মাইল দূরে থেকেও বোঝবার কোনো উপায় নেই যুদ্ধের আসল খবরটা কী। চীনা সামরিক কর্তৃপক্ষ যে সংবাদ পাঠাচ্ছে সেই সংবাদই ছাপা হচ্ছে। এইরকমই হয় সর্বত্রই, অথচ খবরের কাগজের পাঠকেরা তা জেনেও জানে না। খবরের কাগজে লিখিত সংবাদ বাইবেল বা পুরাণের মতো অভ্রান্ত সত্য হিসেবে মেনে নেয়, এইটেই আশ্চর্য। এ সম্বন্ধে ওদের অভিজ্ঞতা আরও পরে যা হয়েছিল তা আরও অদ্ভুত।
কাগজের এক কোণে একটি সংবাদের দিকে মিনি ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করলে। মার্শাল চিয়াং কেই শেক চা-পেই পল্লির বোমাবিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শনে আসবেন রাত নটার সময়ে।
মিনি হাতঘড়ি দেখে বললে–এখন পৌনে ন-টা।
বিমল বললে–তাহলে হাসপাতালেও যাবেন, চলো আমরা হাসপাতালে ফিরি। মার্শাল চিয়াংকে কখনো দেখিনি, দেখা যাবে এখন।
এমন সময়ে ওদের সামনের রাস্তায় একটি হইচই উঠল। রাস্তার দু-ধারে লোকজন সারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চীনা পুলিশম্যান রাস্তার মাঝখানে লোক হটিয়ে দিলে। এক মিনিটের মধ্যে পর পর ছ-খানা মোটরকার দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল। রাস্তার জনতা চীনা ভাষায় চিৎকার করে বলে উঠল–মহাচীনের জয়! মার্শাল চিয়াং-এর জয়! টেনথ রুট আর্মির জয়!
এ্যালিস বললে–এই মার্শাল চিয়াং গেলেন!
বিমল বললে–তবে আর হাসপাতালে এখন ফিরে কী হবে? চলো কনসেশনে ফিরি। রাত হয়েছে, এ অঞ্চল এখন রাত্রে বেড়াবার পক্ষে নিরাপদ নয়। জাপানি বোমা তো আছেই,
তা ছাড়া তার চেয়েও খারাপ চীনা দস্যুদের উপদ্রব। সঙ্গে মেয়েরা
সুরেশ্বর বললে–তা ছাড়া ঘুমোতেও তো হবে। কাল সকাল থেকে আবার ডিউটি—
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
কনসেশনে ফিরবার পথে ওদের বিপদ ঘটল।
কনসেশনে ফিরবার পথে ওরা চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউ দিয়ে খানিকটা এসে পড়ল একটা জনবহুল পাড়াতে। সেখানে দু-খানা রিকশাভাড়া করে ওরা তাদের কনসেশনে যেতে বললে। তারপর ওরা গল্প ও গুজবে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে–যখন ওরা আবার রাস্তার দিকে নজর করলে তখন দেখলে রিকশা একটা নির্জন জায়গা দিয়ে যাচ্ছে। দু-ধারে দরিদ্র লোকেদের কাঁচা মাটির খাপরা-ছাওয়া ঘর। রাস্তা জনশূন্য–দূরে দূরে খোলা মাঠের মধ্যে কী যেন মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে।
বিমল বললে–এ কোথায় নিয়ে এসে ফেল্লে হে?
সুরেশ্বর পিজিন ইংলিশে একজন রিকশাওয়ালাকে বললে–কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস রে? এ পথ তো নয়?
রিকশাওয়ালা কোনো উত্তর না দিয়েই জোরে ছুটতে লাগল।
বিমলের মনে সন্দেহ হল। সে বললে–এর মনে কোনো বদমাইশি মতলব আছে মনে হচ্ছে। আমরা তো একেবারে নিরস্ত্র। সঙ্গে মেয়েরা রয়েছে–
মিনি ও এ্যালিস তখন একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে। ওরাও বললে–আর গিয়ে দরকার নেই –চীনা গুন্ডা এই সময় দেশ ছেয়ে ফেলেছে। নামো এখানে সব।
দু-খানা রিকশাই পাশাপাশি যাচ্ছিল। এবার মিনিদের রিকশাখানা এগিয়ে গেল এবং বিমল কিছু বলবার পূর্বেই রিকশাখানা হঠাৎ পথের মোড় ঘুরে পাশের একটা সংকীর্ণ গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
বিমলদের রিকশাখানা কিন্তু তখন সোজা রাস্তা বেয়েই দ্রুত চলেছে। বিমলের ও সুরেশ্বরের চিৎকারে সে আদৌ কর্ণপাত করলে না।