বলতে বলতে একখানা এরোপ্লেনের আওয়াজ শোনা গেল মাথার ওপর। বিমলের মুখ শুকিয়ে গেল–সামনে উদ্যত মৃত্যুকে কে না ভয় করে? সবাই ওপরের দিকে চাইলে। ড্রাইভার অ্যাক্সিলারেটর পা দিয়ে চেপে স্পিড তুললে হঠাৎ বেজায়।
বিমল চেয়ে দেখলে এরোপ্লেনখানা যেন আরও নীচে নামল–কিন্তু ভাগ্যের জোরেই হোক বা অন্য কারণেই হোক– শেষপর্যন্ত সেখানা ওদের ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।
ড্রাইভার বললে–জাপানি কাওয়াসাকি বম্বার–ভীষণ জিনিস–নীচু হয়ে দেখলে এ গাড়িতে চীনেম্যান আছে কিনা, থাকলে বোমা ফেলত।
সুরেশ্বর বললে–উঃ কানের কাছ দিয়ে তির গিয়েছে।
এতক্ষণ যেন গাড়ির সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিল, এইবার একযোগে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখলে সেখানে এত আহত নর-নারী এনে ফেলা হয়েছে যে কোথাও এতটুকু জায়গা নেই। এদের বেশিরভাগ স্ত্রীলোক ও বালক-বালিকা। যুদ্ধের সৈন্যও আছে– তবে তাদের সংখ্যা তত বেশি নয়।
একটি দশ-এগারো বছরের ফুটফুটে সুন্দর-মুখ বালকের একখানা পা একেবারে গুঁড়িয়ে গিয়েছে–আশ্চর্যের বিষয় ছেলেটি তখনও বেঁচে আছে এবং কিছুক্ষণ আগে অজ্ঞান হয়ে থাকলেও এখন তার জ্ঞান হয়েছে এবং যন্ত্রণায় সে আর্তনাদ করছে। বিমলের ওয়ার্ডেই সে বালকটি আছে। এ্যালিস সেই ওয়ার্ডেই নার্স।
এ্যালিস পেশাদার নার্স নয়, বয়সেও নিতান্ত তরুণী, চোখের জল রাখতে পারলে না ছেলেটির যন্ত্রণা দেখে। বিমলকে বললে–একে মরফিয়া খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখো না?
বিমল বললে–তা উচিত হবে না। ওকে এখুনি ক্লোরোফর্মে অজ্ঞান করে পা কেটে ফেলতে হবে। অপারেশন টেবিল একটাও খালি নেই, সব ভরতি। একটা টেবিল খালি পেলেই ওকে চড়িয়ে দেবে।
এ্যালিস বালকটির শিয়রে বসে কতরকমে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলে–কিন্তু ওদের সবারই মুশকিল চীনা ভাষা সামান্য এক-আধটু বুঝতে পারলেও বলতে আদৌ পারে না।
সুরেশ্বর হাসপাতালে ঔষধালয়ে সহকারী কম্পাউণ্ডার হয়েছে। সে দু-খানা চীনা বর্ণপরিচয় কোথা থেকে জোগাড় করে এনে ওদের দিয়েছে। এ্যালিস বললে–সুরেশ ঠিক বলছিল সেদিন, এসো তুমি, আমি, মিনি ভালো করে চীনে ভাষা শিখি, নইলে কাজ করতে পারব না–
আর্ত বালকটির শয়নশিয়রে এ্যালিসকে যেন করুণাময়ী দেবীর মতো দেখাচ্ছে, বিমল সে দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। এ্যালিসের প্রতি শ্রদ্ধায় তার মন ভরে উঠল।
সন্ধ্যা সাতটার সময় টেবিল খালি হল।
বালকটিকে টেবিলে নিয়ে গিয়ে তোলা হয়েছে, কতকগুলি ডাক্তারি ছাত্র কিছুদূরে একটা গ্যালারিতে বসে আছে, হাসপাতালের সহকারী সার্জন চীনাম্যান, তিনি ছাত্রদের দিকে চেয়ে কী বলছেন আর একজন ছাত্র ক্লোরোফর্ম পাম্প করছে। বিমল ও এ্যালিস সার্জনকে সাহায্য করবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। সার্জন হেসে বললেন, সকাল থেকে অপারেশনে টেবিলে মরেছে একুশটা, টেবিল থেকে নামাবার তর সয়নি–গরম জলটা সরিয়ে দাও নার্স
এমন সময়ে মাথার ওপরে কোথায় এরোপ্লেনের শব্দ শোনা গেল।
বাইরে যারা ছিল, তারা দৌড়ে ভেতরে এলে, একটা ছুটোছুটি শুরু হল চারিদিকে।
কে একজন বললে–জাপানি বম্বার!
এ্যালিস বললে– রেডক্রসের লাল আলো জ্বলছে বাইরে–হাসপাতাল বলে বুঝতে পারবে–
সার্জন হেসে বললে–নার্স, ওরা কি কিছু মানছে? শক্ত করে ধরে থাকো তুলোটা—
বালক অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। সার্জন ক্ষিপ্র ও কৌশলী হাতে ছুরি চালাচ্ছেন। বিমল নাড়ি ধরে আছে।
বুম-ম-ম-ম!–বিকট বিস্ফোরণের শব্দ কোথাও কাছেই। তুমুল গোলমাল হইচই, আর্তনাদ, হাসপাতালের বাঁ-দিকের অংশে বোমা পড়েছে। উগ্র ধোঁয়া ও নাইট্রোগ্লিসারিনের গন্ধে ঘর ভরে গেল। সার্জন, বিমল বা এ্যালিসের দৃষ্টি কোনোদিকে নেই–ওরা একমনে কাজ করছে। সার্জন দৃঢ় অবিকম্পিত হস্তে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছেন, যেন তার অপারেশন টেবিলের থেকে এক-শো গজের মধ্যে প্রলয়কান্ড ঘটেনি, যেন তনি মোটা ফি নিয়ে বড়োলোক রোগীর বাড়ি গিয়ে নিজের নৈপুণ্য দেখাতে ব্যস্ত; গরম জলের পাত্রে ডোবানো ছুরি, ফরসেপ ঘুচ ক্ষিপ্রহস্তে একমনে সার্জনকে জুগিয়ে চলেছে এ্যালিস, একমনে ব্যাণ্ডেজের সারি গুছিয়ে রাখছে, পাতলা লিন্ট-কাপড়ে মলম মাখাচ্ছে। বিমল নাড়ি ধরে আছে।
বাইরে বিকট শব্দ–হুড়মুড় করে হাসপাতালের বাঁ-দিকের উইং-এর ছাদ ভেঙে পড়ল। মহাপ্রলয় চলেছে সে-দিকে–
সার্জন বললেন–নাড়ির বেগ কত?
বিমল–সত্তর।
কে একজন ছুটতে ছুটতে এসে বললে–স্যার, বাঁ-দিকের উইং গুঁড়ো হয়ে গোটা সেপটিক ওয়ার্ডের রোগী চাপা পড়েছে–এদিকেও বোমা পড়তে পারে–তিনখানা বহুবার–
সার্জন বললেন–পড়লে উপায় কী? নার্স বড়ো ফরসেপটা—
উগ্র ধোঁয়ায় সবারই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর একটা শব্দ অন্য কোনদিকে হল– আর একটা বোমা পড়েছে–বেজায় ধোঁয়া আসছে ঘরে।
বিমল বললে–স্যার, ধোঁয়ায় রোগী দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে যে? ক্লোরোফর্মের রোগী, এভাবে কতক্ষণ রাখা যাবে?
সার্জন ছুরি ফেলে বললেন–হয়ে গিয়েছে। লিন্ট দাও, নার্স।
বিমল বললে–স্যার, রোগীর নাড়ি নেই। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
সার্জন এসে নাড়ি দেখলেন। এ্যালিস নীরবে ওদের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
নাড়ি থেকে হাত নামিয়ে সার্জন গম্ভীর মুখে বললেন–বাইশটা পুরল।