প্রোফেসর লি-র মুখ উদার হাসিতে ভরে গেল। বললেন–বেশ তাই হবে।
একটা বড়ো রকমের আওয়াজের দিকে এই সময় প্রোফেসর লি-র জনৈক ছাত্র ওদের সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করলে।
বিমল বললে–বন্দরের দিকে এখনও গোলাবর্ষণ চলছে, হাতাহাতি যুদ্ধও চলছে– ঠিক এই সময় পুলিশম্যান ঘরের দোরের কাছে এসে চীনাভাষায় কী জিজ্ঞেস করলে– লোকটা যেন খুব ব্যস্ত ও উত্তেজিত–সে চলে গেলে প্রোফেসর বললেন–ও বলে গেল খাওয়াদাওয়া শেষ করে কেউ যেন আজ ঘরের বার না হয়–বিশেষত মেয়েরা। জাপানিরা বেওনেট চার্জ করেছিল–আমাদের সৈন্যরা হটিয়ে দিয়েছে শেনসু প্রাচীরের পূর্ব কোণে। কিন্তু আজ রাত্রে আবার ওরা গোলা মারবে, বোমাও ছুড়বে।
চা পান শেষ হল। বিমল বললে– প্রোফেসর লি, মেয়েরা রয়েছেন সঙ্গে, আজ যাই। কনসেশনে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
এ্যালিস বললে–দাদু, আমার একটা খোকা?
প্রোফেসর লি এ্যালিসের মাথায় হাত দিয়ে খেলার ছলে সস্নেহে বলেন– বেওয়ারিশ যদি কোনো খোকা থাকে, পাবে এ্যালিস। কিন্তু কী করবে চীনা ছেলে নিয়ে?
এ্যালিসের এ হাস্যকর অনুরোধ শুনে মিনি তো হেসেই খুন।
চলো চলো এ্যালিস কনসেশনে একটা জ্যান্ত খোকা নিয়ে তোমায় ঢুকতে দেবে কি?
ওরা যখন ফিরে আসছে, দূরে মাঝে মাঝে দুমদাম বিস্ফোরণের শব্দ এবং সাহায্যকারী এরোপ্লেনের হাউইয়ের সাদা অগ্নিময় ধূম দেখা যাচ্ছিল। তবে যেন পূর্বাপেক্ষা অনেক মন্দীভূত হয়ে এসেছে।
সেই রাত্রে কীসের বিষম আওয়াজে বিমলের ঘুম ভেঙে গেল– সে ধড়মড় করে উঠে বিছানার ওপর বসল–কর্ডাইটের শ্বাসরোধকারী ধূমে ও বিশ্রী গন্ধে ঘরটা ভরে গিয়েছে।
ও ডাকলে–সুরেশ্বর–সুরেশ্বর ওঠো–কনসেশনে বোমা পড়ছে!
সঙ্গেসঙ্গে যথেষ্ট হইচই উঠল চারিদিকে।
বোমা! বোমা!
ওরা জানালা দিয়ে দেখলে, যে-ঘরের মধ্যে ওরা শুয়েছিল–তার পুব দিকে আর একটা ঘরের দেওয়াল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়েছে। সেই গোলমালের মধ্যে ভিড় ঠেলে এ্যালিস ছুটতে ছুটতে ওদের ঘরের মধ্যে ঢুকে ডাকলে বিমল! বিমল!
বিমল বললে–এই যে এ্যালিস, তোমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি? মিনি কোথায়?
বলতে বলতে মিনিও ঘরে ঢুকল। বললে–বাইরে এসো, দেখো শিগগির–চট করে এসো–
ওরা বাইরে গেল। কনসেশনের পুলিশের ডেপুটি মার্শাল এসে পৌঁছেছেন দুর্ঘটনার স্থানে। সবাই আকাশের দিকে চাইলে, দু-খানা এরোপ্লেন চলে যাচ্ছে–আলো নিবিয়ে। জনৈক ফরাসি কর্মচারী দেখে বললে–কাওয়াসাকি বহুবার!
বিমল বললে–এ্যালিস, কী করে চেনা গেল জিজ্ঞেস করো না?
মিনি বললে–আমি জানি। নীচের দিকে উইং-এ কালো আঁজি কাটা ছুঁচোমুখ প্লেন এই হল জাপানিদের বিখ্যাত বোমা ফেলবার প্লেন কাওয়াসাকি বহুবার। কিন্তু কনসেশনে বোমা! এ-রকম তো কখনো–
সে-রাত্রে আর কারো ঘুম হল না। বিমল খুব খুশি না হয়ে পারলে না, তার মঙ্গলা মঙ্গলের দিকে এ্যালিসের এত আগ্রহদৃষ্টি দেখে। সেই রাত্রে বোমা পড়েছে শুনে এ্যালিস সকলের আগে এসেছে তাঁকে দেখতে, সে কেমন আছে।
শেষ রাত্রের দিকে সবাই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল কিন্তু শোরগোলে ওদের ঘুম ভেঙে গেল।
ভীষণ গোলাবর্ষণের শব্দ আসছে–সাংহাই শহরে জাপানি যুদ্ধজাহাজ ও এরোপ্লেন থেকে একযোগে গোলা ও বোমা বৃষ্টি হচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে সাংহাই শহর থেকে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ ছেলে-মেয়ে পালিয়ে আসছে। কনসেশনে–বাক্স, তেরঙ্গ, পোঁটলা-পুঁটুলি নিয়ে, ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে। এদের সবারই মুখে ভীষণ ভয়ের চিহ্ন–এদের চক্ষু উদবেগে ও রাত্রি জাগরণে রক্তবর্ণ, চুল রুক্ষ; পাশব বলের কাছে মানুষের কী শোচনীয় পরাজয়!
বেলা দশটার মধ্যে ব্রিটিশ কনসেশনের হাসপাতাল ও মার্কিন রেডক্রশের বড়ো হাসপাতাল আহতের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
কী ভীষণ আওয়াজ ও গোলমাল পেনসু প্রাচীরের দিকে, সমুদ্রের থেকে মাইল দুই দূরে পূর্ব কোণে। সেখানে চীনা টেনথ রুট আর্মির সঙ্গে জাপানি নৌসৈন্যদের যুদ্ধ চলছে। কনসেশন থেকে যুদ্ধস্থলের দূরত্ব প্রায় তিন মাইল, বিমল জিজ্ঞেস করে জানলে। এ ছাড়াও গোলাবর্ষণ চলছে শহরের বিভিন্ন স্থানে।
টেলিফোনে অর্ডার এল মেডিকেল ইউনিটের বড়ো ডাক্তারের কাছে থেকে–বিমল, সুরেশ্বর, এ্যালিস ও মিনিকে চ্যাং-লিন অ্যাভিনিউতে চীনা সামরিক হাসপাতালে যাবার জন্যে।
ওরা আমেরিকান রেডক্রস মোটরে সামরিক হাসপাতালের দিকে ছুটল। ড্রাইভার খুব বড়ো একটা রেডক্রশ পতাকা গাড়ির বনেটে উড়িয়ে দিলে–এ ছাড়া গাড়ির ছাদের বাইরের পিঠে সারা ছাদ জুড়ে একটা প্রকান্ড লাল ক্রস আঁকা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও ড্রাইভার বললে– যদি আপনারা হাসপাতালে পৌঁছোতে পারেন, সে খুব জোর বরাত বুঝতে হবে আপনাদের।
সুরেশ্বর ও বিমল একযোগে বললে কেন?
কনসেশন বা রেডক্রশ কিছুই মানছে না জাপানি বোমারু প্লেন। কালও আমাদের রেডক্রশ ভ্যানে বোমা ফেলেছে– শোনেননি আপনারা সে-কথা?
সে-কথা না শোনাই ভালো। ওদের মোটর কনসেশন থেকে বার হয়ে খানিকটা ফাঁকা মাঠ দিয়ে তির বেগে ছুটল। বিমল দেখলে ড্রাইভার মাঝে মাঝে উপরের দিকে উদবিগ্নদৃষ্টিতে চেয়ে কী দেখছে।
বিমল বললে–কী দেখছ?
বোমারু প্লেন আসছে কিনা দেখছি! এখন আপনাদের পৌঁছে দিতে পারব কিনা জানিনে –তবে চেষ্টা করব–