এ্যালিস বললে–কী হয়েছে?
বিমল বললে–জাপানি সৈন্যদল যুদ্ধজাহাজ থেকে নেমেছে শহরে–তারা শহর আক্রমণ করছে শুনছি। এইদিকেই আসছে। তাদের হাতে পড়া আদৌ আনন্দদায়ক ব্যাপার হবে না–তোমার হাতে ওকী?
মিনি বললে–একটা ছোট্ট ছেলে। একে কোথায় রাখি বলো তো এখন?
সুরেশ্বর একজন ব্যস্ত ও উত্তেজিত পুলিশম্যানকে জিজ্ঞেস করে জানলে–সমুদ্রের ধারে জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে চীনাদের হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। জাপানিরা নগরে প্রবেশ করবার চেষ্টা করছে।
এ্যালিস বললে–আমরা এখন ছোটো ছেলেটিকে কোথায় রাখি বলো না? কনসেশনের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। ওর বাপ-মা এই অঞ্চলের অধিবাসী। ছেলের সন্ধান পাবে না কনসেশনে নিয়ে গেলে।
বিমল বললে–পুলিশম্যানদের জিম্মা করে দাও না।
এ্যালিস ও মিনি তাতে রাজি হল না। এই সব চীনা পুলিশম্যান দায়িত্বজ্ঞানহীন, ওদের হাতে ছোট্ট ছেলেকে ওরা দেবে না।
সমস্ত গলিটা বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে লোকজন অন্ধকারে তার মধ্যে কী-সব খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমন সময়ে পাশের একটা স্কুপে দু-তিনটি হারিকেন লণ্ঠন ও টর্চ জ্বালিয়ে একদল ছোকরা একটি মৃতদেহের ঠ্যাং ধরে বার করছে দেখা গেল।
বিমল উত্তেজিত সুরে বলে উঠল– প্রোফেসর লি! প্রোফেসর লি!
তারপরেই সে ছুটে গেল ছোকরার দলের দিকে। সুরেশ্বর দেখলে ছোকরার দলের নেতা হচ্ছেন দাড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধ–এবং তিনি তাদের পূর্বপরিচিত প্রোফেসর লি।
সেই মুমূর্যদের আর্তনাদ ও পথের লোকের চিৎকারের মধ্যে তিনজনের ব্যাকুল প্রশ্ন বিনিময় হল। প্রোফেসর লি তাঁর ছাত্রদল নিয়ে নিকটেই এক সরাইখানায় ছিলেন–হঠাৎ এই বোমাবর্ষণের দুর্যোগ–এখন তিনি সেবাব্রতী, ছাত্রদের নিয়ে হতাহতদের টেনে বার করা ও তাদের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন।
এ্যালিস ও মিনির সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেওয়া হল।
বিমল বললে– প্রোফেসর লি, এই ছোটো ছেলেটির কী ব্যবস্থা করা যায় বলুন তো?
সদানন্দ, সৌম্য বৃদ্ধ হাত পেতে বললেন–আমায় দাও। তোমরা ওর বাপ-মায়ের সন্ধান করতে পারবে না, আমি পারব। আর কী জান, ছেলে অনেকগুলি জমেছে–চ্যাং, এদের নিয়ে চলো তো? দেখবে এসো তোমরা–যাবার পথে একটু দূর গিয়েই বিমল বলে উঠল– আঃ, কী ব্যাপার দেখো!
সকলেই দেখলে, সে-দৃশ্য যেমন বীভৎস তেমনি করুণ। সেই বৃদ্ধা ভিখারিনি ঠ্যাং ছড়িয়ে মরে পড়ে আছে–সেই জায়গাতেই। একখানা হাত প্রায় চূর্ণ হয়ে গিয়েছে–পাশেই তার ভিক্ষালব্ধ ভাত-তরকারিগুলি রক্তমাখা অবস্থায় পড়ে! আশার জিনিসগুলি–মুখেও দিতে পারেনি হয়তো।
এ্যালিসের চোখে জল এল। বিমল ও সুরেশ্বর মাথার টুপি খুলে বসল। মিনি চোখে রুমাল দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরালে। কেবল অবিচলিত রইলেন প্রোফেসর লি। তিনি ছাত্রদের বললেন, এই মড়াটাকে একটা কিছু ঢাকা দাও তো হে! এ আর কী? আমাদের দেশের এ তো রোজকার ব্যাপার! এতে বিচলিত হলে চলে না মাদাম!
নিকটেই একটা ঘরের মধ্য প্রোফেসর লি ওদের নিয়ে গেলেন। হারিকেন লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেল সে-ঘরের মেঝেতে পাঁচ-ছ-টি নয়-দশমাসের কী এক বছরের শিশু অনাবৃত মেঝের ওপর পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে, কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে।
এ্যালিস ছুটে গিয়ে তাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললে– ও ইউ পুওর ডিয়ারিজ!
প্রোফেসর লি হেসে বললেন–সন্ধ্যা থেকে এতগুলি উদ্ধার করেছি স্তূপ থেকে। আপনাদেরটিও দিন। আমার দু-টি ছাত্র এখানে পাহারা দিচ্ছে–আমরা খুঁজে এনে এখানে জড়ো করছি–রাখো এখানে।
গোলমাল ও ভিড় তখন একটু কমেছে। প্রোফেসর লি সকলকে বললেন–আসুন, একটু চা খাওয়া যাক–রাত্রে আর ঘুম হবে না আজ, সারারাত এইরকম চলবে দেখছি–
যে-ঘরে শিশুগুলিকে জড়ো করা হয়েছে, তার পাশেই একটি ছোটো বাড়িতে লি থাকেন তাঁর ছাত্রবৃন্দ নিয়ে। দু-জন ছাত্রকে শিশুদের কাছে রেখে বাকি সকলে ওদের নিয়ে গেল তাদের সেই বাসায়।
ছোটো ছোটো পেয়ালায় দুধ-চিনি-বিহীন সবুজ চা, শসার বিচি ভাজা, শরবতি লেবুর টুকরো এবং বাঙালি মেয়েদের পাঁয়জোড়ের মতো দেখতে শুয়োরের চর্বিতে ভাজা এক প্রকার কী খাবার।
সুরেশ্বর ও বিমল শেষোক্ত খাবার ঠেলে রেখে দিলে, সে কী এক ধরনের বিশ্রী গন্ধ খাবারে!
প্রোফেসর লি বললেন–আপনারা বিদেশি। আমাদের দেশকে সাহায্য করতে এসেছেন, কিন্তু আমাদের দেশের এখনও কিছুই দেখেননি, দেখলে আপনাদের দয়া হবে। এত গরিব দেশ আর এমন হতভাগ্য–
মিনি বললে–আমাদের সব দেখাবেন দয়া করে প্রোফেসর লি। দেখতেই তো এসেছি– এ্যালিস বললে–আর একটি দেশ আছে প্রোফেসর লি। ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় পড়ে আছে। ছেলেবেলা থেকে দুস্থ ভারতবর্ষের কথা শুনলে কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়।
বিমল এ্যালিসের দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চোখে চাইলে–বড়ো ভালো লাগল এই বিদেশিনি বালিকার এই নিষ্কপট নিঃস্বার্থ সহানুভূতি তার দরিদ্র স্বদেশের জন্যে।
এ্যালিস বললে–শিশুগুলির কে আছে? পুওর লিটল মাইটস। আমায় একটি খোকা দেবেন প্রোফেসর লি?
প্রোফেসর লি হেসে বললেন–কী করবে মিস—
এ্যালিস বললে–আমাদের নাম ধরে ডাকবেন প্রোফেসর লি, ওর নাম মিনি, আমার নাম এ্যালিস। আমরা আপনাকে দাদু বলে ডাকব–কেমন?
এই সদানন্দ উদার, সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধকে এ্যালিসের বড়ো ভালো লেগে গেল। কিউরিও দোকানে বিক্রি হয় যে চীনে মাটির হাস্যমুখ বুদ্ধ-বৃদ্ধের মুখখানা ঠিক যেন তেমনি পরিপূর্ণ সন্তোষ, আনন্দ ও প্রেমের ভাব মাখানো।