তারপর ওরা স্ত্রীলোকটির কাছে পায়ে পায়ে গেল। আহা, যেন মূর্তিমতী দারিদ্র্যের ছবি। ভারতবর্ষীয় লোকে তবুও স্নান করে, গায়-মাথায় তেল দেয়, ওরা তাও করে না–গায়ে খড়ি উঠছে, মাথা রক্ষ, শরীর অন্নাভাবে শীর্ণ ও জ্যোতিহীন। হতভাগ্য মহাচীন, হতভাগ্য ভারতবর্ষ! দু-জনেই দরিদ্র, কেউ খেতে পায় না,–শুরু-শিষ্য দু-জনের অবস্থাই সমান।
বিমলের মনে মনে এই দরিদ্রা নারী, এই দরিদ্র, হতভাগ্য, উৎপীড়িত মহাচিনের এই ভয়ার্ত, অসহায় কুঁড়েঘরবাসী চাষিমজুর–এদের প্রতি একটা গভীর অনুকম্পা ও সহানুভূতি জাগল। মানুষ যখন দুঃখকষ্ট পায়, সবদেশে সর্বকালে তারা এক। চীন, ভারতবর্ষ, রাশিয়া, আবিসিনিয়া, স্পেন, মেক্সিকো, এদের মধ্যে দেশের সীমা এখানে মুছে গিয়েছে।
এই অভাগিনী ভয়ব্যাকুলা দরিদ্র নারী সমগ্র চীনদেশের প্রতীক।
বিমল এসেছে এক হতভাগ্য দেশ থেকে–এই হতভাগ্য দেশকে সাহায্য করতে। সে তা যথাসাধ্য করবে। দরকার হলে বুকের রক্ত দিয়েও করবে।
২. এরা ডাকাত নয়
স্ত্রীলোকটি যখন বুঝতে পারলে যে এরা ডাকাত নয় বা বিদ্রোহী রেড আর্মির লোকও নয়, তখন সে উঠে ঘরে গিয়ে জল নিয়ে এসে সবাইকে খাওয়ালে।
ধাতুপাত্র বা চীনা মাটির পাত্র নেই বাড়িতে, এত গরিব সাধারণ লোক। লাউয়ের খোেলায় জল রেখেছে।
চীনের বিশ্ববিখ্যাত মাটির বাসন, মিং রাজত্বের অপূর্ব প্রাচীন শিল্প, পুতুল, খেলনা, বুদ্ধ, দানব, এসব এই গরিবদের জন্যে নয়।
রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে খুব ভিড়। একখানা সৈন্যবাহী ট্রেন সিনকিউ থেকে সাংহাই যাচ্ছে –প্রত্যেক স্টেশনে আবার নতুন ভরতি-করা সৈন্যদের ওই ট্রেনেই উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুরেশ্বর বিমলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ট্রেনের ছাদের দিকে।
সব কামরার ছাদে কাঁচা ডালপালা চাপানো–কোনোটায় শুকনো খড় বিচালি ছাওয়া।
বিমল বললে–এরোপ্লেন পাছে বোমা ফেলে ট্রেনে, তাই ওরকম করেছে বলে মনে হয়।
সাংহাই ৪৫০ মাইল দূরে।
হঠর হঠর করে করে সারাদিন ট্রেন কৃষিক্ষেত্র, অনুচ্চ পাহাড়, গ্রাম আর বস্তি পার হয়ে চলেছে, চলেছে। ট্রেনের গতি মন্দ নয়, পুরোনো আমলের ইঞ্জিন বদলে নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়েছে, বেশ জোরেই ট্রেন যাচ্ছে।
ওদের কামরাতে সাধারণ সৈন্যদল নেই অবিশ্যি। মাত্র জন্য আষ্টেক লোক, সবাই অফিসার শ্রেণির, কিন্তু কেউ ইংরেজি জানে না। মহা অসুবিধেয় পড়ে গেল ওরা–কিছু দরকার হলে চাওয়া যায় না, নতুন কিছু দেখলে জিজ্ঞেস করা যায় না যে সেটা কী।
দুপুরের দিকে একটা ছোটো শহরে গাড়ি দাঁড়াল এবং ওদের কামরাতে একজন সাদা সরু একগুচ্ছ লম্বা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ সৌম্যমূর্তি ভদ্রলোক উঠলেন, সঙ্গে তাঁর এগারোটি তরুণ যুবা। এদের সবারই বেশ সুন্দর কমনীয় চেহারা।
বিমল বললে–গুড মর্নিং স্যার।
বৃদ্ধের মুখ দেখে মনে হয় জগতে তাঁর আপন-পর কেউ নেই। তিনি সবাইয়ের ওপর সন্তুষ্ট, জীবনে সবাইকে ভালোবেসেছেন।
তিনি হাসিমুখে ইংরেজিতে বললেন–গুড মর্নিং, আপনারা কোথায় যাবেন।
বিমল বললে–সাংহাই। আপনারা কী অনেকদূর যাবেন?
আমরা যাচ্ছি সাংহাই। আমি এখানকার কলেজের প্রোফেসর। আমার নাম লি। আমি সেখানে যাচ্ছি, যুদ্ধের সময়কার মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে। এদেরও নিয়ে যাচ্ছি, এরা সবাই আমার ছাত্র। সদানন্দ বৃদ্ধ কথা শেষ করে গর্বিত দৃষ্টিতে তাঁর এগারোটি তরুণ ছাত্রের দিকে চাইলেন। বিমল ও সুরেশ্বরের বড়ো অদ্ভুত মনে হল। এই ভয়ানক দিনে ইনি মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে চলেছেন সাংহাইতে, এতগুলি বালকের জীবন বিপন্ন করে।
একটু পরে বৃদ্ধের একটি ছাত্র একটি বেতের বাক্স থেকে কীসব খাবার বার করে সবাইকে খেতে দিলে। বৃদ্ধ সুরেশ্বর ও বিমলকেও তাঁদের সঙ্গে খেতে আহ্বান করলেন।
সুরেশ্বর নিম্নস্বরে বললে–খেয়ে না বিমল। ইঁদুর ভাজা কিংবা আরশোলা চচ্চড়ি বোধ হয়।
কিন্তু সেসব কিছু নয়। শরবতি লেবুর রস দেওয়া কুমড়োর বিচি ভাজা আর শসার আচার।
বিমল বললে, প্রোফেসর লি, আপনি সাংহাইতে কোথায় উঠবেন। আমাদের সঙ্গে থাকুন না, আমরা যেখানে থাকব? হঠাৎ এরোপ্লেনের আওয়াজ কানে গেল–গাড়িসুদ্ধ সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখবার চেষ্টা করলে কোনদিক থেকে আওয়াজটা আসছে।
ছ-খানা এরোপ্লেন সারবন্দি হয়ে উড়ে পুব থেকে পশ্চিমের দিকে আসছে। ট্রেনখানার বেগ হঠাৎ বড়ো বেড়ে গেল। সকলেই উদবিগ্ন হয়ে পড়েছে, পরস্পরের মুখের দিকে চাইছে। কিন্তু এরোপ্লেনের সারি ট্রেনের ঠিক ওপর দিয়েই উড়ে চলে গেল শান্তভাবেই।
প্রোফেসর লি দিব্যি নির্বিকার ভাবেই বসেছিলেন। তিনি বললেন–আমাদের গভর্নমেন্টের এরোপ্লেন।
একটা স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম থেকে নারীকণ্ঠের কান্না শুনে বিমল ও সুরেশ্বর মুখ বাড়িয়ে দেখলে, কতকগুলি সৈন্য একটি দরিদ্রা স্ত্রীলোকের চারিধারে ঘিরে হাসছে–স্ত্রীলোকটির সামনে একটা শূন্য ফলের ঝুড়ি–এদিকে সৈন্যদের প্রত্যেকের হাতে এক-একটা খরমুজ।
বিমল বললে–প্রোফেসর লি, আমরা তো নতুন দেশে এসেছি, কিছু বুঝিনে এদেশের ভাষা। বোধ হয় খরমুজওয়ালির সব ফল এরা কেড়ে নিয়ে দাম দিচ্ছে না। আপনি একবার দেখুন না।
বৃদ্ধ তাঁর এগারোটি ছাত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বাধা দিলেন সৈন্যদের। চীনা ভাষায় তুবড়ি ছুটল উভয় পক্ষেই।