- বইয়ের নামঃ মরণের ডঙ্কা বাজে
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ গদ্যপদ্য
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. চাঁদপাল ঘাট
মরণের ডঙ্কা বাজে – কিশোর উপন্যাস – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
চাঁদপাল ঘাট থেকে রেঙ্গুনগামী মেল স্টিমার ছাড়ছে। বহু লোকজনের ভিড়। পুজোর ছুটির ঠিক পরেই। বর্মা প্রবাসী দু-চারজন বাঙালি পরিবার রেঙ্গুনে ফিরচে। কুলিরা মালপত্র তুলচে। দড়াদড়ি ছোঁড়াছুড়ি, হইহই। ডেকযাত্রীদের গোলমালের মধ্যে জাহাজ ছেড়ে গেল। যারা আত্মীয়স্বজনকে তুলে দিতে এসেছিল, তারা তীরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়তে লাগল।
সুরেশ্বরকে কেউ তুলে দিতে আসেনি। কারণ কলকাতায় তার জানাশোনা বিশেষ কেউ নেই! সবে চাকরিটা পেয়েছে, একটা বড়ো ঔষধ-ব্যবসায়ী ফার্মের ক্যানভাসার হয়ে সে যাচ্ছে রেঙ্গুন ও সিঙ্গাপুর।
সুরেশ্বরের বাড়ি হুগলি জেলার একটা গ্রামে। বেজায় ম্যালেরিয়ায় দেশটা উচ্ছন্ন গিয়েছে, গ্রামের মধ্যে অত্যন্ত বনজঙ্গল, পোড়ো বাড়ির ইট পাকার হয়ে পথে যাতায়াত বন্ধ করেছে, সন্ধ্যার পর সুরেশ্বরদের পাড়ায় আলো জ্বলে না।
ওদের পাড়ায় চারিদিকে বনজঙ্গল ও ভাঙা পোডড়াবাড়ির মধ্যে একমাত্র অধিবাসী সুরেশ্বররা। কোনো উপায় নেই বলেই এখানে পড়ে থাকা–নইলে কোন কালে উঠে গিয়ে শহর-বাজারের দিকে বাস করত ওরা।
সুরেশ্বর বি. এস-সি. পাস করে এতদিন বাড়িতে বসে ছিল। চাকরি মেলা দুর্ঘট আর কে-ই বা করে দেবে–এই সবের জন্যেই সে চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। তার বাবা সম্প্রতি পেনসন নিয়ে বাড়ি এসে বসেছেন, খুব সামান্যই পেনসন–সে আয়ে সংসার চালানো কায়ক্লেশে হয়; কিন্তু তাও পাড়াগাঁয়ে। শহরে সে আয়ে চলে না। বছর খানেক বাড়ি বসে থাকবার পরে সুরেশ্বর গ্রামে আর থাকতে পারলে না। গ্রামে নেই লোকজন। তার সমবয়সি এমন কোনো ভদ্রলোকের ছেলে নেই যার সঙ্গে দু-দন্ড কথাবার্তা বলা যায়। সন্ধ্যা আটটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়াই গ্রামের নিয়ম। তারপর কোনোদিকে সাড়াশব্দ নেই।
ক্রমশ এ জীবন সুরেশ্বরের অসহ্য হয়ে উঠল। সে ঠিক করলে কলকাতায় এসে টিউশনি করেও যদি চালায়, তবুও তো শহরে থাকতে পারবে এখন।
আজ মাস পাঁচ-ছয় আগে সুরেশ্বর কলকাতায় আসে এবং দেশের একজন পরিচিত লোকের মেসে ওঠে। এতদিন এক-আধটা টিউশনি করেই চালাচ্ছিল, সম্প্রতি এই চাকরিটা পেয়েছে, তারই এক ছাত্রের পিতার সাহায্যে ও সুপারিশে। সঙ্গে তিন বাক্স ঔষধ-পত্রের নমুনা আছে বলে তাদের ফার্মের মোটরগাড়ি ওকে চাঁদপাল ঘাটে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল।
এই প্রথম চাকরি এবং এই প্রথম দূর বিদেশে যাওয়া–সুরেশ্বরের মনে খানিকটা আনন্দ ও খানিকটা বিষাদ মেশানো এক অদ্ভুত ভাব। একদল মানুষ আছে, যারা অজানা দূর বিদেশে নতুন নতুন বিপদের সামনে পড়বার সুযোগ পেলে নেচে ওঠে–সুরেশ্বর ঠিক সে দলের নয়। সে নিতান্তই ঘরকুনো ও নিরীহ ধরনের মানুষ–তার মতো লোক নিরাপদে চাকরি করে আর দশজন বাঙালি ভদ্রলোকের মতো নির্বিঘ্নে সংসারধর্ম পালন করতে পারলে সুখী হয়।
তাকে যে বিদেশে যেতে হচ্ছে–তাও যে-সে বিদেশ নয়, সমুদ্র পারের দেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে–সে নিতান্তই দায়ে পড়ে। নইলে চাকরি থাকে না! সে চায়নি এবং ভেবেও রেখেছে এইবার নিরাপদে ফিরে আসতে পারলে অন্য চাকরির চেষ্টা করবে।
কিন্তু জাহাজ ছাড়বার পরে সুরেশ্বরের মন্দ লাগছিল না। ধীরে ধীরে বোটানিক্যাল গার্ডেন, দুই তীর-ব্যাপী কলকারখানা পেছনে ফেলে রেখে প্রকান্ড জাহাজখানা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। ভোর ছটায় জাহাজ ছেড়েছিল, এখন বেশ রৌদ্র উঠেছে, ডেকের একদিকে অনেকখানি জায়গায় যাত্রীরা ডেক-চেয়ার পেতে গল্পগুজব জুড়ে দিয়েছে, স্টিমারের একজন কর্মচারী সবাইকে বলে গেল পাইলট নেমে যাওয়ার আগে যদি ডাঙায় কোনো চিঠি পাঠানো দরকার হয় তা যেন লিখে রাখা হয়।
বয় এসে বললে–আপনাকে চায়ের বদলে আর কিছু দেব?
সুরেশ্বর সেকেণ্ড ক্লাসের যাত্রী, সে চা খায় না, এখবর আগেই জানিয়েছিল এবং কিছু আগে সকলকে চা দেওয়ার সময়ে চায়ের পেয়ালা সে ফেরত দিয়েছে।
সুরেশ্বর বললে–না, কিছু দরকার নেই।
বয় চলে গেল।
এমন সময় কে একজন বেশ মার্জিত ও ভদ্র সুরে পেছনের দিক থেকে জিজ্ঞেস করলে– মাপ করবেন, মশায় কি বাঙালি।
সুরেশ্বর পেছনে ফিরে বিস্মিত হয়ে চেয়ে দেখলে এইমাত্র একজন নব আগন্তুক যাত্রী তার ডেক-চেয়ার পাতবার মাঝখানে থমকে দাঁড়িয়েছে ও তাকে প্রশ্ন করছে। তার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি নয়, একহারা, দীর্ঘ সুঠাম চেহারা। সুন্দর মুখশ্রী, চোখ দুটি বুদ্ধির দীপ্তিতে উজ্জ্বল–সবসুদ্ধ মিলিয়ে বেশ সুপুরুষ।
সুরেশ্বর উত্তর দেওয়ার আগেই সে লোকটি হাসিমুখে বললে–কিছু মনে করবেন না, একসঙ্গেই ক-দিন থাকতে হবে আপনার সঙ্গে, একটু আলাপ করে নিতে চাই। প্রথমটা বুঝতে পারিনি আপনি বাঙালি কিনা।
সুরেশ্বর হেসে বললে–এর আর মনে করবার কী? ভালোই তো হল আমার পক্ষেও। সেকেণ্ড ক্লাসে আর কি বাঙালি নেই?
না, আর যাঁরা যাচ্ছেন–সবাই ডেকে। একজন কেবল ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী। আপনি কতদূর যাবেন–রেঙ্গুনে?
আপাতত তাই বটে–সেখান থেকে যাব সিঙ্গাপুর।