দু-দিন পরে শ্রীগোপাল এসে আমায় খবর দিলে, গ্রামের মহীন স্যাকরাকে সে ডেকে এনেচে–আমায় সঙ্গে দেখা করবে, বিশেষ কাজ আছে।
মহীন স্যাকরার বয়স প্রায় পঞ্চাশের ওপর। নিতান্ত ভালোমানুষ গ্রাম্য-স্যাকরা, ঘোরপ্যাঁচ জানে না বলেই মনে হল।
শ্রীগোপালকে বললাম–একে কেন এনেচ?
এ কী বলছে শুনুন।
কী মহীন?
বাবু, ননী ঘোষ আমার কাছে এগারো ভরি সোনার তাবিজ আর হার তৈরি করে নিয়েছে –আজ তিন-চারদিন আগে।
দাম কত?
সাতাশ টাকা করে ভরি, হিসেব করুন।
টাকা নগদ দিয়েছিল?
হ্যাঁ বাবু।
সে টাকা তোমার কাছে আছে? নোট, না নগদ?
নগদ। টাকা নেই বাবু, তাই নিয়ে মহাজনের ঘর থেকে সোনা কিনে এনে গহনা গড়ি!
দু-একটা টাকাও নেই?
না বাবু।
তোমার মহাজনের কাছে আছে?
বাবু, রানাঘাটের শীতল পপাদ্দারের দোকানে কত সোনা কেনা-বেচা হচ্ছে দিনে। আমার সে টাকা কী তারা বসিয়ে রেখেছে?
শীতল পোদ্দার নাম? আমার সঙ্গে তুমি চলো রানাঘাটে আজই।
.
বেলা তিনটের ট্রেনে মহীন স্যাকরাকে নিয়ে রানাঘাটে শীতল পোদ্দারের দোকানে হাজির হলাম। সঙ্গে মহীনকে দেখে বুড়ো পোদ্দারমশায় ভাবলে, বড়ো খরিদ্দার একজন এনেচে মহীন। তাদের আদর-অভ্যর্থনাকে উপেক্ষা করে আমি আসল কাজের কথা পাড়লাম, একটু কড়া–রুক্ষস্বরে।
বললাম– সেদিন এই মহীন আপনাদের ঘর থেকে সোনা কিনেছিল এগারো ভরি?
পোদ্দারের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল ভয়ে–ভাবলে, এ নিশ্চয়ই পুলিশের হাঙ্গামা! সে ভয়ে ভয়ে বললে–হ্যাঁ বাবু, কিনেছিল।
টাকা নগদ দেয়?
তা দিয়েছিল।
সে টাকা আছে?
না বাবু, টাকা কখনো থাকে? আমাদের বড়ো কারবার কোথাকার টাকা কোথায় গিয়েছে!
আমিও ওকে দেখানোর জন্যে কড়া সুরে বললাম–ঠিক কথা বলো। টাকা যদি থাকে আনিয়ে দাও তোমার ভয় নেই! চুরির ব্যাপার নয়, মহীনের কোনো দোষ নেই। তোমাদের কোনো পুলিসের হাঙ্গামায় পড়তে হবে না– কেবল কোর্টে সাক্ষী দিতে হতে পারে। টাকা বার করো।
মহীনও বললে– পোদ্দারমশায়, আমাদের কোনো ভয় নেই, বাবু বলেচেন। টাকা যদি থাকে, দেখান বাবুকে।
পোদ্দার বললে–কিন্তু বাবু, একটা কথা। টাকা তো সব সমান, টাকার গায়ে কি নাম লেখা আছে?
সে-কথায় তোমার দরকার নেই। নাম লেখা থাক না থাক–টাকা তুমি বার করো।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ
শীতল পোদ্দার টাকা বার করে নিয়ে এল একটা থলির মধ্যে থেকে। বললে– সেদিনকার তহবিল আলাদা করা ছিল। সোনা বিক্রির তহবিল আমাদের আলাদা থাকে, কারণ, এই নিয়ে মহাজনের সোনা কিনতে যেতে হয়। টাকা হাতে নিয়ে দেখবার আগেই শীতল একটা কথা বললে– যা আমার কাছে আশ্চর্য বলে মনে হল। সে বললে–বাবু, এগুলো পুরোনো টাকা, পোঁতা-টোতা ছিল বলে মনে হয়, এ চুরির টাকা নয়।
আমি প্রায় চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে! মহীন স্যাকরার মুখ দেখি বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।
আমি বললাম–তুমি কী করে জানলে এ পুরোনো টাকা?
দেখুন আপনিও হাতে নিয়ে! পুরোনো কলঙ্ক-ধরা রুপো দেখলে আমাদের চোখে কি চিনতে বাকি থাকে বাবু। এই নিয়ে কারবার করচি যখন!
কতদিনের পুরোনো টাকা এ?
বিশ-পঁচিশ বছরের।
টাকাগুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম, বিশ বৎসরের পরের কোনো সালের অঙ্ক টাকার গায়ে লেখা নেই। বললাম–মাটিতে পোঁতা টাকা বলে ঠিক মনে হচ্চে?
নিশ্চয়ই বাবু। পেতলের হাঁড়িতে পোঁতা ছিল। পেতলের কলঙ্ক লেগেচে টাকার গায়ে।
আচ্ছা, তুমি এ-টাকা আলাদা করে রেখে দাও। আমি পুলিশ নই, কিন্তু পুলিশ শিগগির এসে এ-টাকা চাইবে মনে থাকে যেন।
শীতল পোদ্দার আমার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে অনুনয়ের সুরে বললে- দোহাই বাবু, দেখবেন, যেন আমি এর মধ্যে জড়িয়ে না পড়ি। কোনো দোষে দোষী নই বাবু, মহীন আমার পুরোনো খাতক আর খদ্দের, ও কোথা থেকে টাকা এনেচে তা কেমন করে জানব বাবু, বলুন?
মহীনকে নিয়ে দোকানের বাইরে চলে এলাম। দেখি, ও ভয়ে কেমন বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। বললাম–কী মহীন তোমার ভয় কী? তুমি গাঙ্গুলিমশায়কে খুন করনি তো?
মহীন বললে–খুন? গাঙ্গুলিমশায়কে? কী যে বলেন বাবু?
দেখলাম ওর সর্বশরীর যেন থরথর করে কাঁপছে।
কেন, ওর এত ভয় হল কীসের জন্যে?
আমরা ডিটেকটিভ, আসামি ধরতে বেরিয়ে কাউকে সাধু বলে ভাবা আমাদের স্বভাব নয়। মি. সোম আমার শিক্ষাগুরু–তাঁর একটি মূল্যবান উপদেশ হচ্ছে, যে-বাড়িতে খুন হয়েছে বা চুরি হয়েছে– সে বাড়ির প্রত্যেককেই ভাববে খুনি ও চোর। প্রত্যেককে সন্দেহের চোখে দেখবে, তবে খুনের কিনারা করতে পারবে–নতুবা পদে পদে ঠকতে হবে।
ননী ঘোষ তো আছেই এর মধ্যে, এ-সন্দেহ আমার এখন বদ্ধমূল হল। বিশেষ করে টাকা দেখবার পরে আদৌ সে-সন্দেহ না থাকবারই কথা।
কিন্তু এখন আবার একটা নতুন সন্দেহ এসে উপস্থিত হল।
এই মহীন স্যাকরার সঙ্গে খুনের কী কোনো সম্পর্ক আছে?
কথাটা ট্রেনে বসে ভাবলাম। মহীনও কামরায় একপাশে বসে আছে। সে আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি–জানলা দিয়ে পান্ডুর বির্বণ মুখে ভীত চোখে বাইরের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মহীনের যোগাযোগে ননী ঘোষ খুন করেনি তো? দুজনে মিলে হয়তো এ-কাজ করেছে। কিংবা এমনও কী হতে পারে না যে, মহীনই খুন করেছে, ননী ঘোষ নির্দোষ?
তবে একটা কথা, ননী ঘোষের হাতেই খাতাপত্র–কত টাকা আসচে-যাচ্চে, ননীই তো জানত, মহীন স্যাকরা সে-খবর কী করে রাখবে!…