একখানা হাতচিঠে-কাগজের পাতা নিয়ে এসে দারোগাবাবু আমার হাতে দিলেন।
আমি হাতে নিয়ে বললাম–এ তো ননীর হাতের লেখা নয়!
না, এ গণেশের হাতের লেখাও নয়।
সরফরাজ তরফদারও নয়। কারণ, সে মারা যাওয়ার পরে লেখা। তারিখ দেখুন।
তবে, খুনের অনেকদিন আগে এ লেখা হয়েছে–চার মাসেরও বেশি আগে।
ব্যাপারটা ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ছে মশায়। আমি একটা জিনিস আপনাকে তবে দেখাই।
দারোগাবাবুর হাতে কাঠের পাতটা দিয়ে বললাম–এ-জিনিসটা দেখুন।
দারোগাবাবু সেটা হাতে নিয়ে বললেন–কী এটা?
কী জিনিসটা তা ঠিক বলতে পারব না। তবে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে এটা কুড়িয়ে পেয়েছি। আর একটা জিনিস দেখুন।
বলে শেওড়ালের গোড়াটা তাঁর হাতে দিতেই তিনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন–এ তো একটা শুকনো গাছের ডাল–এতে কী হবে?
ওতেই একটা মস্ত সন্ধান দিয়েছে। জানেন? যে খুন করেছে, সে ভোর রাত পর্যন্ত গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি ছাড়েনি। ভোরের দিকে রাত পোহাতে দেরি নেই দেখে সরে পড়েছে। যাবার সময় অভ্যাসের বশে শেওড়াডালের দাঁতন করেছে।
দারোগামশায় হো হো করে হেসে উঠে বললেন–আপনারা যে দেখচি মশায়, স্বপ্নরাজ্যে বাস করেন! এত কল্পনা করে পুলিশের কাজ চলে? কোথায় একটা দাঁতনকাঠির ভাঙা গোড়া!
আমি জানি আমার গুরু মি. সোম একবার একটা ভাঙা দেশলাইয়ের কাঠিকে সূত্র ধরে আসামি পাকড়েছিলেন।
দারোগাবাবু হাসতে হাসতে বললেন– বেশ, আপনিও ধরুন না দাঁতনকাঠি থেকে, আমার আপত্তি কী?
যদি আমি এটাকে এত প্রয়োজনীয় মনে না করতাম, তবে এটা এতদিন সঙ্গে নিয়ে বেড়াই? যে দুটো জিনিস পেয়েছি, তাদের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ আছে–এও আমার বিশ্বাস।
কীরকম?
যে দাঁতন কাঠি ভেঙেছে–তার বা তাদের দলের লোকেরা এই কাঠের পাতখানাও।
পাতাখানা কী?
সে-কথা পরে বলব? আর একটা সন্ধান দিয়েছে এই দাঁতনকাঠিটা।
কী?
সেটা এই: দোষীর বা দোষীর দলের কারো দাঁতন করবার অভ্যেস আছে। দাঁতন করবার যার প্রতিদিনের অভ্যেস নেই–সে এ-রকম দাঁতন নিপুণভাবে মোচড় দিয়ে ভাঙতে জানবে না। এবং সম্ভবত সে বাঙালি এবং পল্লিগ্রামবাসী। হিন্দুস্থানিরা দাঁতন করে, কিন্তু দেখবেন, তারা শেওড়াডালের দাঁতন করতে জানে না–তারা নিম, বা বাবলা গাছের দাঁতনকাঠি ব্যবহার করে সাধারণত। এ লোকটা বাঙালি এ-বিষয়ে ভুল নেই।
সেইদিনই আমি কলকাতায় মি. সোমের সঙ্গে দেখা করলাম। শেওড়ালের গোড়াটা আমি তাঁকে দেখাইনি–কাঠের পাতটা তাঁর হাতে দিয়ে বললাম–এটা কী বলে আপনি মনে করেন?
তিনি জিনিসটা দেখে বললেন–এ তুমি কোথায় পেলে?
সে-কথা আপনাকে এখন বলব না, ক্ষমা করবেন।
এটা আসামে মিসমি-জাতির মধ্যে প্রচলিত রক্ষাকবচ। দেখবে? আমার কাছে আছে।
মি. সোমের বাড়িতে নানা দেশের অদ্ভুত জিনিসের একটি প্রাইভেট মিউজিয়াম-মতো আছে। তিনি তাঁর সংগৃহীত দ্রব্যগুলির মধ্যে থেকে সেইরকম একটা কাঠের পাত এনে আমার হাতে দিলেন।
আমি বললাম–আপনারটা একটু বড়ো। কিন্তু চিহ্ন একই–ফুল আর শেয়াল।
এটা ফুল নয়, নক্ষত্র– দেবতার প্রতীক, আর নীচে উপাসনাকারী মানুষের প্রতীক পশু!
কোন দেশের জিনিস বললেন?
নাগা পর্বতের নানা স্থানে এ-কবচ প্রচলিত–বিশেষ করে ডিব্ৰু-সদিয়া অঞ্চলে।
আমি তাঁর হাত থেকে আমার পাতটা নিয়ে তারপর বললাম–এই শেওড়াডালটা ক দিনের ভাঙা বলে মনে হয়?
তিনি বললেন–ভালো করে দেখে দেব? আচ্ছা, বোসো।
সেটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে একটু পরে ফিরে এসে বললেন–আট ন-দিন আগে ভাঙা।
আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম নিজের বাসায়।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আমার মনে একটা বিশ্বাস ক্রমশ দৃঢ়তর হয়ে উঠছে। গাঙ্গুলিমশায়কে খুন করতে এবং খুনের পরে তাঁর ঘরের মধ্যে খুঁড়ে দেখতে খুনির লেগেছিল সারারাত। যুক্তির দিক থেকে হয়তো এর অনেক দোষ বার করা যাবে–কিন্তু আমি অনেক সময় অনুমানের ওপর নির্ভর করে অগ্রসর হয়ে সত্যের সন্ধান পেয়েছি।
কিন্তু ননী ঘোষকে আমি এখনও রেহাই দিইনি। শ্যামপুরে ফিরেই আমি আবার তার সঙ্গে দেখা করলাম। আমায় দেখে ননীর মুখ শুকিয়ে গেল–তাও আমার চোখ এড়াল না।
বললাম– শোনো ননী, আবার এলাম তোমায় জ্বালাতে-কতকগুলি কথা জিগ্যেস করব।
আজ্ঞে, বলুন!
গাঙ্গুলিমশায় যেদিন খুন হন, সে-রাত্রে তুমি কোথায় ছিলে?
ননীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। বললে, আজ্ঞে …
বলো কোথায় ছিলে। বাড়ি ছিলে না–;
আজ্ঞে না। সামটায় শ্বশুরবাড়ি যেতে যেতে সেদিন দেবনাথপুরের হাটতলায় রাত কাটাই।
কেউ দেখেচে তোমায়?
ননী বললে–আজ্ঞে, তা যদিও দেখেনি—
কেন দেখেনি।
রাত হয়ে গেল দেখে ওখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন কেউ সেখানে ছিল না।
খেয়াঘাট পার হওনি দেবনাথপুরে?
হ্যাঁ বাবু। অনেক লোক একসঙ্গে পার হয়েছিল। আমায় তো পাটনি চিনে রাখেনি!
বাড়ি এসেছিলে কবে?
শনিবার দুপুর বেলা।
গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েচেন কার মুখে শুনলে?
আজ্ঞে, গাঁয়ে ঢুকেই মাঠে কাঁপালিদের মুখে শুনি।
কার মুখে শুনেছিলে তার নাম বলো।
আজ্ঞে, ঠিক মনে হচ্ছে না, বোধ হয় হীরু কাপালি–
তার কাছে গিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারবে?
ননী ইতস্তত করে বললে– আজ্ঞে, ঠিক তো মনে নেই; যদি হীরু না হয়?
ননীর কথায় আমার সন্দেহ আরও বেশি হল। সে-রাত্রে ও ঘরে ছিল না, অথচ কোথায় ছিল তা পরিষ্কার প্রমাণও দিতে পারছে না। গোপনে সন্ধান নিয়ে আরও জানলাম, ননী সম্প্রতি কলকাতায় গিয়েছিল। আজ দু-দিন হল এসেছে। ননীকে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই, ও সত্যি কথা বলবে না। একটা কিছু কান্ড ও ঘটাচ্ছে নাকি তলে তলে? কিছু বোঝা যাচ্চে না!