গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়িতে একখানা মাত্র খড়ের ঘর। তার সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট রান্নাঘর। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে যাওয়া যায়। এসব আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
তাকে বললাম–আপনার পিতার হত্যাকারীকে যদি খুঁজে বার করতে পারি, আপনি খুব খুশি হবেন?
সে প্রায় কেঁদে ফেলে বললে–খুশি কী, আপনাকে পাঁচ-শো টাকা দেব।
টাকা দিতে হবে না। আমায় সাহায্য করুন। আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি নে।
নিশ্চয় করব। বলুন কী করতে হবে?
আমার সঙ্গে সঙ্গে আসুন আপাতত। তারপর বলব যখন যা করতে হবে। আচ্ছা, চলুন তো বাড়ির পিছন দিকটা একবার দেখি?
বড় জঙ্গল, যাবেন ওদিকে?
জঙ্গল দেখলে তো আমাদের চলবে না–চলুন দেখি।
সত্যই ঘন আগাছার জঙ্গল আর বড়ো বড়ো বন্যগাছের ভিড় বাড়ির পেছনেই। পাড়াগাঁয়ে যেমন হয়ে থাকে–বিশেষ করে এই শ্যামপুরে জঙ্গল একটু বেশি। বড়ো বড়ো ভিটে লোকশূন্য ও জঙ্গলাবৃত হয়ে পড়ে আছে বহুকাল থেকে। ম্যালেরিয়ার উৎপাতে দেশ উৎসন্ন গিয়েছিল বিশ-ত্রিশ বছর আগে। এখন পাড়ায় পাড়ায় নলকূপ হয়েছে জেলাবোর্ডের অনুগ্রহে, ম্যালেরিয়াও অনেক কমেছে–কিন্তু লোক আর ফিরে আসেনি।
জঙ্গলের মধ্যে বর্ষার দিনে মশার কামড় খেয়ে হাত-পা ফুলে উঠল। আমি প্রত্যেক স্থান তন্নতন্ন করে দেখলাম। সাত-আটদিনের পূর্বের ঘটনা, পায়ের চিহ্ন যদি কোথাও থাকতে পারে–তবে এখানেই তা থাকা সম্ভব।
কিন্তু জায়গাটা দেখে হতাশ হতে হল।
জমিটা মুথে-ঘাসে ঢাকা–বর্ষায় সে ঘাস বেড়ে হাতখানেক লম্বা হয়েছে। তার ওপর পায়ের দাগ থাকা সম্ভবপর নয়।
আমার মনে হল, খুনি রাত্রে এসেছিল ঠিক এই পথে। সামনের পথ লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে–কখনই সে-পথে আসতে সাহস করেনি।
অনেকক্ষণ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেও সন্দেহজনক কোনো জিনিস চোখে পড়ল না– কেবল এক জায়গায় একটা শেওড়াগাছের ডাল ভাঙা অবস্থায় দেখে আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলেকে বললাম–এই ডালটা ভেঙে কে দাঁতন করেছিল, আপনি?
গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে আশ্চর্য হয়ে বললে–না, আমি এ-জঙ্গলে দাঁতন-কাঠি ভাঙতে আসব কেন?
তাই জিগ্যেস করচি।
আপনি কী করে জানলেন, ডাল ভেঙে কেউ দাঁতন করেছে?
ভালো করে চেয়ে দেখুন। একরকম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুচড়ে ভেঙেচে ডালটা–তা ছাড়া এতগুলি শ্যাওড়াডালের মধ্যে একটিমাত্র ডাল ভাঙা। মানুষের হাতে ভাঙা বেশ বোঝা যাচ্চে। দাঁতনকাঠি সংগ্রহ ছাড়া অন্য কী উদ্দেশ্যে এভাবে একটি ডাল কেউ ভাঙতে পারে?
আপনার দেখবার চোখ তো অদ্ভুত! আমার তো মশাই চোখেই পড়ত না!
আচ্ছা, দেখে বলুন তো, কত দিন আগে এ-ডালটা ভাঙা হয়েছে?
অনেক দিন আগে।
খুব বেশি দিন আগে না। মোচড়ানো-অংশের গোড়াটা দেখে মনে হয়, ছ-সাতদিন আগে। এর চেয়েও নিখুঁতভাবে বলা যায়। ওই অংশের সেলুলোজ অণুবীক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা করলে ধরা পড়বে। আমি এই গাছের ভাঙা-ডালটা কেটে নিয়ে যাব, একটা দা আনুন তো দয়া করে?
গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলের মুখ দেখে বুঝলাম সে বেশ একটু অবাক হয়েছে। ভাঙাদাঁতনকাঠি নিয়ে আমার এত মাথাব্যথার কারণ কী বুঝতে পারছে না।
সে পিছন ফিরে দা আনতে যেতে উদ্যত হলকিন্তু দু-চার পা গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে ঘাসের মধ্যে থেকে কী একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে বললে–এটা কী?
আমি তার হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে দেখলাম, সেটা একটা কাঠের ছোট্ট গোলাকৃতি পাত। ভালো করে আলোয় নিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখলাম, পাতের গায়ে একটা খোদাই কাজ। একটা ফুল, ফুলটার নীচে একটি শেয়ালের মতো জানোয়ার।
শ্রীগোপাল বললে–এটা কী বলুন তো?
আমি বুঝতে পারলাম না, কী জিনিস এটা হতে পারে তাও আন্দাজ করতে পারলাম না। জিনিসটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। যাবার আগে শেওড়াগাছের ভাঙা ডালের গোড়াটা কেটে নিয়ে এলাম।
২. পরদিন থানায়
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পরদিন থানায় গিয়ে দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করে আমার পরিচয় দিলাম।
তিনি আমায় সমাদর করে বসালেনআমায় বললেন, তাঁর দ্বারা যতদূর সাহায্য হওয়া সম্ভব তা তিনি করবেন।
আমি বললাম–আপনি এ-সম্বন্ধে কিছু তদন্ত করেছেন?
তদন্ত করা শেষ করেছি। তবে, আসামি বার-করা ডিটেকটিভ ভিন্ন সম্ভব নয় এক্ষেত্রে।
ননী ঘোষকে আমার সন্দেহ হয়।
আমারও হয়, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হবে না।
ওকে চালান দিন না, ভয় খেয়ে যাক! খুনের রাত্রে ও অনুপস্থিত ছিল। কোথায় ছিল তার সন্তোষজনক প্রমাণ দিতে পারেনি।
আপনি ওকে চালান দিতে পরামর্শ দেন?
দিলে ভালো হয়। এর মধ্যে আর একটা উদ্দেশ্য আছে–বুঝেছেন নিশ্চয়ই।
দারোগাবাবু হেসে বললেন–এতদিন পুলিসের চাকরি করে তা আর বুঝিনি মশায়? ওকে চালান দিলে সত্যিকার হত্যাকারী কিছু অসতর্ক হয়ে পড়বে এবং যদি গা-ঢাকা দিয়ে থাকে, তবে বেরিয়ে আসবে–এই তো?
ঠিক তাই–যদিও ননী ঘোষকে আমি বেশ সন্দেহ করি। লোকটা ধূর্ত-প্রকৃতির।
কাল আমি লোকজন নিয়ে গ্রামে গিয়ে ডেকে বলব–ননীকে কালই চালান দেব।
চালান দেওয়ার সময় গ্রামের সব লোকের সেখানে উপস্থিত থাকা দরকার।
দারোগাবাবু বললেন–দাঁড়ান, একটা কথা আছে। হিসেবের খাতার একখানা পাতা সেদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম গাঙ্গুলিমশায়ের ঘরে। পাতাখানা একবার দেখুন।