আর একটা ব্যাপার, খুনটা টাটকা নয়, সাতদিন আগে খুন হয়ে লাশ পর্যন্ত দাহ শেষ সব ফিনিশ– গোলমাল চুকে গিয়েছে।
চোখে দেখিনি পর্যন্ত সেটা–অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন-টিহ্নগুলি দেখলেও তো যা হয় একটি ধারণা করা যেত। এ একেবারে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া! ভীষণ সমস্যা।
মি. সোমকে কী একখানা চিঠি লিখে তাঁর পরামর্শ চেয়ে পাঠাব? এমন অবস্থায় পড়লে তিনি নিজে কী করতেন জানাতে বলব?
কিন্তু তাও তো উচিত নয়।
মামা যখন বলেছেন, এটা যদি আমার পরীক্ষা হয়, তবে পরীক্ষার হলে যেমন ছেলেরা কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে নেয় না–আমায় তাই করতে হবে।
যদি এর কিনারা করতে পারি, তবে মামা বলেছেন, আমাকে এ-লাইনে রাখবেন–নয়ত মি. সোমের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেবেন, নিয়ে হয়তো কোনো আর্টিস্টের কাছে রেখে ছবি আঁকতে শেখাবেন বা বড়ো দরজির কাছে রেখে শার্ট তৈরি, পাঞ্জাবি তৈরি শেখাবেন।
তবে শিক্ষানবিশের প্রথম পরীক্ষা-হিসেবে পরীক্ষা যে বেশ কঠিন, এতে কোনো ভুল নেই।…
বসে-বসে আরও অনেক কথা ভাবলুম।
…হিসেবের খাতা যে লিখত, সে নিশ্চয়ই জানত ঘরে কত টাকা মজুত, বাইরে কত টাকা ছড়ানো। তার পক্ষে জিনিসটা জানা যত সহজ, অপরের পক্ষে তত সহজ নয়।
এ-বিষয়েও একটা গোলমাল আছে। গাঙ্গুলিমশায় টাকার গর্ব মুখে করে বেড়াতেন যেখানে-সেখানে। কত লোক শুনেচে-কত লোক হয়তো জানত।
একটা কথা আমার হঠাৎ মনে এল।
কিন্তু, কাকে কথাটা জিজ্ঞেস করি?
ননী ঘোষের বাড়ি গিয়ে ননী ঘোষের সঙ্গে দেখা করা একবার বিশেষ দরকার। তাকেই একথা জিগ্যেস করতে হবে। সে নাও বলতে পারে অবশ্য–তবুও একবার জিজ্ঞেস করতে দোষ নেই।…
ননী ঘোষ বাড়িতেই ছিল। আমায় সে চেনে না, একটু তাচ্ছিল্য ও ব্যস্ততার সঙ্গে বললে –কী দরকার বাবু? বাড়ি কোথায় আপনার?
আমি বললাম–তোমার সঙ্গে দরকারি কথা আছে। ঠিক উত্তর দাও। মিথ্যে বললে বিপদে পড়ে যাবে।
ননীর মুখ শুকিয়ে গেল। দেখলাম সে ভয় পেয়েছে। বুঝেছে যে, আমি গাঙ্গুলিমশায়ের খুন সম্পর্কে তদন্ত করতে এসেছি–নিশ্চয়ই পুলিসের সাদা পোশাক-পরা ডিটেকটিভ।
সে এবার বিনয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললে–বাবু, যা জিগ্যেস করেন, করুন।
গাঙ্গুলিমশায়ের খাতা তুমি লিখতে?
ননী ইতস্তত করে বললে–তা ইয়ে–আমিও লিখিচি দু-একদিন–আর ওই গণেশ বলে একটা স্কুলের ছেলে আছে, তাকে দিয়েও–
আমি ধমক দিয়ে বললাম–স্কুলের ছেলের কথা হচ্ছে না–তুমি লিখতে কিনা?
ননী ভয়ে ভয়ে বললে–আজ্ঞে, তা লেখতাম।
কতদিন লিখচ? মিথ্যে কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে। ঠিক বলবে।
প্রায়ই লেখতাম। দু-বছর ধরে লিখচি।
আর কে লিখত?
এই যে স্কুলের ছেলে গণেশ—
তার কথা ছেড়ে দাও, তার বয়েস কত?
পনেরো-ষোলো হবে।
আর কে লিখত?
আর, সরফরাজ তরফদার লিখত, সে এখন—
সরফরাজ তরফদারের বয়েস কত? কী করত?
সে এখন মারা গিয়েছে।
বাদ দাও সে-কথা। কতদিন মারা গিয়েছে?
দু-বছর হবে।
এইবার একটা কথা জিগ্যেস করি–গাঙ্গুলিমশায়ের কত টাকা বাইরে ছিল জান?
প্রায় দু-হাজার টাকা।
মিথ্যে বোলো না। খাতা পুলিসের হাতে পড়েছে–মিথ্যে বললে মারা যাবে।
না বাবু, মিথ্যে বলিনি। দু-হাজার হবে।
ঘরে মজুত কত ছিল?
তা জানিনে!
আবার বাজে কথা? ঠিক বলো।
বাবু, আমায় মেরেই ফেলুন আর যাই করুন–মজুত টাকা কত তা আমি কী করে বলব? গাঙ্গুলিমশায় আমায় সে টাকা দেখায়নি তো? খাতায় মজুত-তবিল লেখা থাকত না।
একটা আন্দাজ তো আচে? আন্দাজ কী ছিল বলে তোমার মনে হয়?
আন্দাজ আর সাত-আট-শো টাকা।
কী করে আন্দাজ করলে?
ওঁর মুখের কথা থেকে তাই আন্দাজ হত।
গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর কতদিন আগে তুমি শেষ খাতা লিখেছিলে?
প্রায় দু-মাস আগে। দু-মাসের মধ্যে আমি খাতা লিখিনি–আপনার পায়ে হাত দিয়ে বলচি। তা ছাড়া খাতা বেরোলে হাতের লেখা দেখেই তা আপনি বুঝবেন।
কোনো মোটা টাকা কি তাঁর মরণের আগে কোনো খাতকে শোধ করেছিল বলে তুমি মনে করো?
না বাবু! ঊর্ধ্বসংখ্যা ত্রিশ টাকার বেশি তিনি কাউকে ধার দিতেন না, সেটা খুব ভালো করেই জানি। মোটা টাকা মানে, দু-শো-এক-শো টাকা কাউকে তিনি কখনো দেননি।
এমন তো হতে পারে, পাঁচজন খাতকে ত্রিশ টাকা করে শোধ দিয়ে গেল একদিনে? দেড় শো টাকা হল?
তা হতে পারে বাবু, কিন্তু তা সম্ভব নয়। একদিনে পাঁচজন খাতকে টাকা শোধ দেবে না। আর একটা কথা বাবু। চাষি-খাতক সব–ভাদ্রমাসে ধান হবার সময় নয়–এখন যে চাষি প্রজারা টাকা শোধ দিয়ে যাবে, তা মনে হয় না। ওরা শোধ দেয় পৌষ মাসে–আবার ধার নেয় ধান-পাট বুনবার সময়ে চৈত্র-বৈশাখ মাসে। এ-সময় লেন-দেন বন্ধ থাকে।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
কোনো কিছু সন্ধান পাওয়া গেল না ননীর কাছে। তবুও আমার সন্দেহ সম্পূর্ণরূপে গেল না। ননী হয় সম্পূর্ণ নির্দোষ, নয়তো সে অত্যন্ত ধূর্ত। মি. সোম একটা কথা সবসময়ে বলেন, বাইরের চেহারা বা কথাবার্তা দ্বারা কখনো মানুষের আসল রূপ জানবার চেষ্টা কোরো না করলেই ঠকতে হবে। ভীষণ চেহারার লোকের মধ্যে অনেক সময় সাধুপুরুষ বাস করে– আবার অত্যন্ত সুশ্রী ভদ্রবেশী লোকের মধ্যে সমাজের কণ্টকস্বরূপ দানব-প্রকৃতির বদমাইশ বাস করে। এ আমি যে কতবার দেখেচি।
ননীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির পেছনটা একবার ভালো করে দেখবার জন্যে গেলাম।