কিছু না। অনেক রাত্তিরে আমি যখন শুতে যাই–তখনও ওঁর রান্নাঘরে আলো জ্বলতে দেখেছি। আমি ভাবলাম, গাঙ্গুলিমশায় আজ এখনও দেখি রান্না করছেন!
কেন, এ-রকম ভাবলেন কেন?
এত রাত পর্যন্ত তো উনি রান্নাঘরে থাকেন না; সকাল রাত্তিরেই খেয়ে শুয়ে পড়েন। বিশেষ করে সেদিন গিয়েছে ঘোর অন্ধকার রাত্তির–অমাবস্যা, তার ওপর টিপ টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছিল সন্ধ্যে থেকেই।
তখন তো আর আপনি জানতেন না যে, উনি হাট থেকে মাংস কিনে এনেছেন?
না, এমন কিছুই জানি নে। … হ্যাঁ বাবা, … যখন এত করে জিগ্যেস করচ, তখন একটা কথা আমার এখন মনে হচ্ছে–
কী, কী, বলুন?
উনি ভাত খাওয়ার পরে রোজ রাত্তিরে কুকুর ডেকে এঁটো পাতা, কী পাতের ভাত তাদের দিতেন, রোজ রোজ ওঁর গলার ডাক শোনা যেত। সেদিন আমি আর তা শুনিনি।
ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হয়তো।
না বাবা, বুড়ো-মানুষ ঘুম সহজে আসে না। চুপ করে শুয়ে থাকি বিছানায়। সেদিন আর ওঁর কুকুরকে ডাক দেওয়ার আওয়াজ আমার কানেই যায়নি।
ভালো করে জেরা করার ফল অনেক সময় বড়ো চমৎকার হয়। মি. সোম প্রায়ই বলেন –লোককে বারবার করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। যা হয়তো তার মনে নেই, বা, খুঁটিনাটির ওপর সে তত জোর দেয়নি তোমার জেরায় তা তারও মনে পড়বে। সত্য বার হয়ে আসে অনেক সময় ভালো জেরার গুণে।
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সেদিনই আমার সঙ্গে গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে শ্রীগোপালের দেখা হল। সে তার পিতার দাহকার্য শেষ করে ফিরে আসছে কাছাগলায়।
আমি তাকে আড়ালে ডেকে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিলাম। শ্রীগোপালের চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। সে আমাকে সবরকমের সাহায্য করবে প্রতিশ্রুতি দিলে।
আমি বললাম, কারো ওপর আপনার সন্দেহ হয়?
কার কথা বলব বলুন। বাবার একটা দোষ ছিল, টাকার কথা জাহির করে বেড়াতেন সবার কাছে। কত জায়গায় এসব কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে কে এ-কাজ করলে কী করে বলি?
আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব–কিছু মনে করবেন না। আপনার বাবার কত টাকা ছিল জানেন?
বাবা কখনো আমাদের বলতেন না। তবে, আন্দাজ, দু-হাজারের বেশি নগদ টাকা ছিল না।
সে টাকা কোথায় থাকত?
সেটা জানতাম। ঘরের মেঝেতে বাবা পুঁতে রাখতেন–কতবার বলেছি, টাকা ব্যাংকে রাখুন। সেকেলে লোক, ব্যাংক বুঝতেন না।
গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর পর বাড়ি এসে আপনি মেজে খুঁড়ে কিছু পেয়েছিলেন?
মেঝে তো খুঁড়ে রেখেছিল যারা খুন করেছে তারাই। আমি এক পয়সাও পাইনি–তবে একটা কথা বলি–দু-হাজার টাকার সব টাকাই তো মেঝেতে পোঁতা ছিল না–বাবা টাকা ধার দিতেন কিনা! কিছু টাকা লোকজনকে ধার দেওয়া ছিল।
কত টাকা আন্দাজ?
সেদিক থেকেও মজা শুনুন, বাবার খাতাপত্র সব ওই সঙ্গে চুরি হয়ে গিয়েছে। খাতা না দেখলে বলা যাবে না কত টাকা ধার দেওয়া ছিল।
খাতাপত্র নিজেই লিখতেন?
তার মধ্যে গোলমাল আছে। আগে নিজেই লিখতেন, ইদানীং চোখে দেখতে পেতেন না বলে এক-ওকে ধরে লিখিয়ে নিতেন।
কাকে-কাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতেন জানেন?
বেশিরভাগ লেখাতেন সদগোপ-বাড়ির ননী ঘোষকে দিয়ে। সে জমিদারি-সেরেস্তায় কাজ করে–তার হাতের লেখাও ভালো। বাবার কথা সে খুব শুনত।
ননী ঘোষের বয়েস কত?
ত্রিশ-বত্রিশ হবে।
ননী ঘোষ লোক কেমন? তার ওপর সন্দেহ হয়।
মুশকিল হয়েছে, বাবা তো একজনকে দিয়ে লেখাতেন না! যখন যাকে পেতেন, তখন তাকেই ধরে লিখিয়ে নিতেন যে! স্কুলের ছেলে গণেশ বলে আছে, ওই মুখুজ্যে বাড়ি থেকে পড়ে–তাকেও দেখি একদিন ডেকে এনেছেন। শুধু ননী ঘোষের ওপর সন্দেহ করে কী করব?
আর কাকে দেখেছেন?
আর মনে হচ্ছে না।
আপনি হিসেবের খাতা দেখে বলে দিতে পারেন, কোন হাতের লেখা কার?
ননীর হাতের লেখা আমি চিনি। তার হাতের লেখা বলতে পারি–কিন্তু সে খাতাই বা কোথায়? খুনেরা সে খাতা তো নিয়ে গিয়েছে!
কাকে বেশি টাকা ধার দেওয়া ছিল, জানেন?
কাউকে বেশি টাকা দিতেন না বাবা। দশ, পাঁচ, কুড়ি–বড়োজোর ত্রিশের বেশি টাকা একজনকেও তিনি দিতেন না।
.
শ্যামপুরের জমিদারবাড়ি সেবেলা খাওয়া-দাওয়া করলাম।
একটি বড়ো চত্বর, তার চারিধারে নারিকেল গাছের সারি, জামরুল গাছ, বোম্বাই-আমের গাছ, আতা গাছ। বেশ ছায়াভরা উপবন যেন, ডিটেকটিভগিরি করে হয়তো ভবিষ্যতে খাব–তা বলে প্রকৃতির শোভা যখন মন হরণ করে–এমন মেঘমেদুর বর্ষা-দিনে গাছপালার শ্যামশোভা উপভোগ করতে ছাড়ি কেন?
বসলুম এসে চত্বরের একপাশে নির্জন গাছের তলায়।
বসে বসে ভাবতে লাগলুম।
… কী করা যায় এখন? মামা বড়ো কঠিন পরীক্ষা আমার সামনে এনে ফেলেছেন?
মি. সোমের উপযুক্ত ছাত্র কিনা আমি, এবার তা প্রমাণ করার দিন এসেছে।
কিন্তু বসে বসে মি. সোমের কাছে যতগুলি প্রণালী শিখেচি খুনের কিনারা করবার– সবগুলি পাশ্চাত্য-বৈজ্ঞানিক-প্রণালী–স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভের প্রণালী। এখানে তার কোনোটিই খাটবে না। আঙুলের ছাপ নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি করা হয়নি– সাত-আটদিন পরে এখন জিনিসপত্রের গায়ে খুনির আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
পায়ের দাগ সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা।
খুন হবার পর এত লোক গাঙ্গুলিমশায়ের ঘরে ঢুকেচে–তাদের সকলের পায়ের দাগের সঙ্গে খুনির পায়ের দাগ একাকার হয়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। গ্রামের কৌতূহলী লোকেরা আমায় কী বিপদেই ফেলেচে! তারা জানে না, একজন শিক্ষানবিশ-ডিটেকটিভের কী সর্বনাশ তারা করেচে!