সে লাশের সঙ্গে মহকুমায় গিয়েছে। সেখানে লাশ কাটাকুটি করবে ডাক্তারে, তারপর দাহকার্য করে ফিরবে।
লাশ দেখলে বড় সুবিধে হত। সেটা আর হল না
সেইজন্যেই তো বলছি, তুমি কেমন কাজ শিখেচ, এটা তোমার পরীক্ষা। এতে যদি পাস করো তবে বুঝব তুমি মি. সোমের উপযুক্ত ছাত্র। নয়তো তোমাকে আমি আর ওখানে রাখব না–এ আমার এক-কথা জেনো।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তারপর গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি গেলাম।
গিয়ে দেখি, যেখানটাতে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি–তার দু-দিকে ঘন-জঙ্গল। একদিকে দূরে একটা গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা, একদিকে একটি হচ্ছে বাড়ি।
আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলের কথা জিগ্যেস করে জানলাম, সে এখনও মহকুমা থেকে ফেরেনি। তবে একটি প্রৌঢ়ার সঙ্গে দেখা হল–শুনলাম তিনি গাঙ্গুলিমশায়ের আত্মীয়া।
তাঁকে জিগ্যেস করলামগাঙ্গুলিমশায়কে শেষ দেখেছিলেন কবে?
বুধবার।
কখন?
বিকেল পাঁচটার সময়।
কীভাবে দেখেছিলেন?
সেদিন হাটবার ছিল–উনি হাটে যাবার আগে আমার কাছে পয়সা চেয়েছিলেন।
কীসের পয়সা?
সুদের পয়সা। আমি ওঁর কাছে দুটো টাকা ধার নিয়েছিলাম ও-মাসে।
আপনার পর আর কেউ দেখেছিল?
গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির ঠিক পশ্চিমগায়ে যে বাড়ি, সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে প্রৌঢ়া বললেন–ওই বাড়ির রায়-পিসি আমার পরও তাঁকে দেখেছিলেন?
আমি বৃদ্ধা রায়-পিসির বাড়ি গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতেই বৃদ্ধা আমায় আশীর্বাদ করে একখানা পিঁড়ি বার করে দিয়ে বললেন–বোসো বাবা।
আমি সংক্ষেপে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম–আপনি একা থাকেন নাকি এ বাড়িতে।
হ্যাঁ বাবা। আমার তো কেউ নেই–মেয়ে-জামাই আছে, তারা দেখাশুনো করে।
মেয়ে-জামাই এখানে থাকেন?
এখানেও থাকে, আবার তাদের দেশ এই এখান থেকে চার ক্রোশ দূর সাধুহাটি গাঁয়ে, সেখানেও থাকে।–
গাঙ্গুলিমশায়কে আপনি বুধবারে কখন দেখেন?
রাত্তিরে যখন উনি হাট থেকে ফিরলেন–তখন আমি বাইরের রোয়াকে বসে জপ করছিলাম। তারপর আর চোখে না দেখলেও ওঁর গলার আওয়াজ শুনেচি রাত দশটা পর্যন্তউনি ওঁর রান্নাঘরে রাঁধছিলেন আলো জ্বেলে, আমি যখন শুতে যাই তখন পর্যন্ত।
তখন রাত কত হবে?
তা কী বাবা জানি? আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক–ঘড়ি তো নেই বাড়িতে। তবে তখন ফরিদপুরের গাড়ি চলে গিয়েছে। আমরা শব্দ শুনে বুঝি কখন কোন গাড়ি এল-গেল।
একা থাকতেন, আর রাত পর্যন্ত রান্না করছিলেন–এত কী রান্না?
সেদিন মাংস এনেছিলেন হাট থেকে। মাংস সেদ্ধ হতে দেরি হচ্ছিল।
আপনি কী করে জানলেন?
পরে আমরা জেনেছিলাম। হাটে যারা ওঁর সঙ্গে একসঙ্গে মাংস কিনেছিল–তারা বলেছিল। তা ছাড়া যখন রান্নাঘর খোলা হলবাবাগো!
বলে বৃদ্ধা যেন সে দৃশ্যের বীভৎসতা মনের পটে আবার দেখতে পেয়ে শিউরে উঠে কথা বন্ধ করলেন। সঙ্গে যে প্রৌঢ়া আত্মীয়টি ছিলেন গাঙ্গুলিমশায়ের, তিনিও বললেনও বাবা, সে রান্নাঘরের কথা মনে হলে এখনও গা ডোল দেয়!
আমি আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলামকেন? কেন?কী ছিল রান্নাঘরে?
বৃদ্ধা বললেন–থালার চারদিকে ভাত ছড়ানোমাংসের ছিবড়ে আর হাড়গোড় ছড়ানো।
বাটিতে তখনও মাংস আর ঝোল রয়েছে–ঘরের মেঝেতে ধস্তাধস্তির চিহ্ন–তিনি খেতে বসেছিলেন এবং তাঁর খাওয়া শেষ হবার আগেই যারা তাঁকে খুন করে তারা এসে পড়ে।
প্রৌঢ়াও বললেন–হ্যাঁ বাবা, এ সবাই দেখেচে। পুলিশও এসে রান্নাঘর দেখে গিয়েছে। সকলেরই মনে হল, ব্রাহ্মণের খাওয়া শেষ হবার আগেই খুনেরা এসে তার ওপর পড়ে।
আচ্ছা বেশ, এ গেল বুধবার রাতের ব্যাপার। সেদিনই হাট ছিল তো?
হ্যাঁ বাবা, তার পরদিন সকালে উঠে আমরা দেখলাম, ওঁর ঘরের দরজা বাইরের দিকে তালা-চাবি দেওয়া। প্রথম সকলেই ভাবলে উনি কোথাও কাজে গিয়েচেন, ফিরে এসে রান্নাবান্না করবেন। কিন্তু যখন বিকেল হয়ে গেল, ফিরলেন না–তখন আমরা ভাবলাম, উনি ওঁর ছেলেদের কাছে কলকাতায় গেছেন।
তারপর?
বিষ্যুদবার গেল, শুক্রবার গেল, শুক্রবার বিকেলের দিকে বন্ধ-ঘরের মধ্যে থেকে কীসের দুর্গন্ধ বেরোতে লাগলতাও সবাই ভাবলে, ভাদ্রমাস, গাঙ্গুলিমশায় হয়তো তাল কুড়িয়ে ঘরের মধ্যে রেখে গিয়েছিলেন তাই পচে অমন গন্ধ বেরোচ্ছে।
শনিবার আপনারা কোন সময় টের পেলেন যে, তিনি খুন হয়েছেন?
শনিবারে আমি গিয়ে গ্রামের ভদ্রলোকদের কাছে সব বললাম। অনেকেই জানত না যে, গাঙ্গুলিমশায়কে এ ক-দিন গাঁয়ে দেখা যায়নি। তখন সকলেই এল। গন্ধ তখন খুব বেড়েছে! পচা তালের গন্ধ বলে মনে হচ্ছে না!
কী করলেন আপনারা?
তখন সকলে জানলা খোলবার চেষ্টা করলে, কিন্তু সব জানলা ভেতর থেকে বন্ধ। দোর ভাঙাই সাব্যস্ত হল। পরের ঘরের দোর ভেঙে ঢোকা ঠিক নয়–এরপর যদি তা নিয়ে কোনো কথা ওঠে। তখন চৌকিদার আর দফাদার ডেকে এনে তাদের সামনে দোর ভাঙা হল।
কী দেখা গেল?
দেখা গেল, তিনি ঘরের মধ্যে মরে পড়ে আছেন! মাথায় ভারি জিনিস দিয়ে মারার দাগ। মেজে খুঁড়ে রাশীকৃত মাটি বার করা, ঘরের বাক্স-প্যাঁটরা সব ভাঙা, ডালা খোলা–সব তচনচ করেচে জিনিসপত্র। … তারপর ওঁর ছেলেদের টেলিগ্রাম করা হল।
এ ছাড়া আর কিছু আপনারা জানেন না?
না বাবা, আর আমরা কিছু জানি নে।
গাঙ্গুলিমশায়ের প্রতিবেশিনী সেই বৃদ্ধাকে জিগ্যেস করলামরাত্রে কোনোরকম শব্দ শুনেছিলেন? গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি থেকে?