তা কথার ভাবে বুঝেচি।
কী করে বুঝলে?
অন্য কিছু নয় বউ-ছেলেরা কলকাতায় থাকে, উনি থাকেন দেশের বাড়িতে। একটা চাকর কী রাঁধুনি রাখেন না, হাত পুড়িয়ে এ-বয়সে বেঁধে খেতে হয় তাও স্বীকার। অথচ হাতে দু পয়সা বেশ আছে।
আর কিছু লক্ষ করলে?
বড়ো গল্প বলা স্বভাব! আমার ধারণা, একটু বাড়িয়েও বলেন।
ঠিক ধরেচ। মাছ নিইনি তার আর-একটি কারণ, উনি মাছ দিয়ে গেলে সব জায়গায় সে গল্প করে বেড়াবেন, আর লোকে ভাববে আমরা কি চামারপুকুরে মাছ ধরেছে বলে ওঁর কাছ থেকে মাছ নিইচি।
না মামা, এটি আপনার ভুল। একথা ভাববার কারণ কী লোকদের? তা কখনো কেউ ভাবে?
তা যাই হোক, মোটের উপর আমি ওঠা পছন্দ করি নে।
উনি একটা বড়ো ভুল করেন মামাবাবু। টাকার কথা অমন বলে বেড়ান কেন?
ওটা ওঁর স্বভাব। সর্বত্র ওই করবেন। যেখানে বসবেন, সেখানেই টাকার গল্প। করেও আজ আসছেন বহুদিন। দেখাতে চান, হাতে দু-পয়সা আছে।
আমার মনে হয় ও-স্বভাবটা ভালো নয়বিশেষ করে এইসব পাড়াগাঁয়ে। একদিন আপনি একটু সাবধান করে দেবেন না?
সে হবে না। তুমি ওঁকে জান না। বড্ড একগুঁয়ে। কথা তো শুনবেনই নাআরও ভাববেন, নিশ্চয়ই আমার কোনো মতলব আছে।
আমি সেদিন কলকাতায় চলে এলাম বিকেলের ট্রেনে। আমার ওপরওয়ালা নিবারণবাবু লিখেছেন, খুব শিগগির আমায় একবার এলাহাবাদে যেতে হবে বিশেষ একটা জরুরি কাজে। অফিসে যেতেই খবর পেলাম, তিনি আর-একটা কাজে দু-দিনের জন্য পাটনা গিয়েচেন চলেআমার এলাহাবাদ যাবার খরচের টাকা ও একখানা চিঠি রেখে গিয়েছেন তাঁর টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে।
আমার কাছে তাঁর ড্রয়ারের চাবি থাকে। ড্রয়ার খুলে চিঠিখানা পড়ে দেখলাম, বিশেষ কোনো গুরুতর কাজ নয়এলাহাবাদ গভর্নমেন্ট থাম্ব-ইমপ্রেশন-বুরোতে যেতে হবে, কয়েকটি দাগি বদমাইশের বুড়ো-আঙুলের ছাপের একটা ফোটো নিতে।
মি. সোম বুড়ো-আঙুলের ছাপ সম্বন্ধে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি।
এলাহাবাদের কাজ শেষ করতে আমার লাগল মাত্র একদিন, আট-দশদিন রয়ে গেলাম তবুও।
সেদিন সকালবেলা হঠাৎ মি. সোমের এক টেলিগ্রাম পেলাম। একটা জরুরি কাজের জন্য আমায় সেইদিনই কলকাতায় ফিরতে লিখেছেন। আমি যেন এলাহাবাদে দেরি না করি।
.
ভোরে হাওড়ায় ট্রেন এসে দাঁড়াতেই দেখি, মি. সোম প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম, কারণ, এরকম কখনো উনি আসেন না।
আমার বললেনসুশীল, তুমি আজই মামার বাড়ি যাও। তোমার মামা কাল দু-খানা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করেছেন তোমায় সেখানে যাবার জন্যে।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম–মামার বাড়ি কারো অসুখ। সবাই ভালো আছে তো?
সেসব নয় বলেই মনে হল। টেলিগ্রামের মধ্যে কারো অসুখের উল্লেখ নেই।
কোনো লোক আসেনি সেখান থেকে?
না। আমি তার করে দিয়েছি, তুমি এলাহাবাদে গিয়েচ। আজই তোমার ফিরবার তারিখ তাও জানিয়ে দিয়েছি।
আমি বাসায় না গিয়ে সোজা শেয়ালদা স্টেশনে চলে এলাম মামার বাড়ি যাবার জন্যে।
মি. সোম আমার সঙ্গে এলেন শেয়ালদা পর্যন্তবার বার করে বলে দিলেন, কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটলে তাঁকে যেন খবর দিইতিনি খুব উদবিগ্ন হয়ে রইলেন।
মামার বাড়ি পা দিতেই বড়ো মামা বললেন–এসেছিস সুশীল? যাক, বড্ড ভাবছিলাম?
কী ব্যাপার মামাবাবু? সবাই ভালো তো?
এখানকার কিছু ব্যাপার নয়। শ্যামপুরের হরিশ গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েছেন। সেখানে এখুনি যেতে হবে।
আমি ভীত ও বিস্মিত হয়ে বললাম–গাঙ্গুলিমশায়। সেদিন যিনি মাছ ধরে গেলেন! খুন হয়েচেন?
হ্যাঁ, চলো একেবার সেখানে। শিগগির স্নানাহার করে নাও। কারণ, সারাদিনই হয়তো কাটবে সেখানে।
বেলা দুটোর সময় শ্যামপুরে এসে পৌঁছোলাম। ছোট্ট গ্রাম। কখনো সেখানে কারো একটা ঘটি চুরি হয়নি–সেখানে খুন হয়ে গিয়েছে, সুতরাং গ্রামের লোকে দস্তুরমতো ভয় পেয়ে গেছে। গ্রামের মাঝখানে বারোয়ারি-পূজা-মন্ডপে জড়ো হয়ে সেই কথারই আলোচনা করছে সবাই।
আমার মামা এখানে এর পূর্বে অনেকবার এসেছিলেন এই ঘটনা উপলক্ষ্যে, তা সকলের কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল। আমার কথা বিশেষ কেউ জিগ্যেস করলে না বা আমার সম্বন্ধে কেউ কোনো আগ্রহও দেখালে না। কেউ জানে না, আমি প্রাইভেট-ডিটেকটিভ মি. সোমের শিক্ষানবিশ ছাত্ৰএসব অজ পাড়াগাঁয়ে ওঁর নামই কেউ শোনেনিআমাকে সেখানে কে চিনবে?
মামা জিগ্যেস করলেন–লাশ নিয়ে গিয়েছে?
ওরা বললেআজ সকালে নিয়ে গেল। পুলিশ এসেছিল।
আমি ওদের বললামব্যাপার কীভাবে ঘটল? আজ হল শনিবার। কবে তিনি খুন হয়েছেন।
গ্রামের লোকে যেরকম বললে তাতে মনে হল, সে-কথা কেউ জানে না। নানা লোক নানা কথা বলতে লাগল। পুলিসের কাছেও এরা এইরকমই বলে ব্যাপারটাকে রীতিমতো গোলমেলে করে তুলেছে।
আমি আড়ালে মামাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম–আপনি কী মনে করে এখানে এনেচেন আমায়?
মামা বললেন–তুমি সব ব্যাপার শুনে নাও, চলো, অনেক কথা আছে। এই খুনের রহস্য তোমায় আবিষ্কার করতে হবেতবে বুঝব মি. সোমের কাছে তোমায় শিক্ষানবিশ করতে দিয়ে আমি ভুল করিনি। এখানে কেউ জানে না তুমি কী কাজ করোসে তোমার একটা সুবিধে।
সুবিধেও বটে, আবার অসুবিধেও বটে।
কেন?
বাইরের বাজে লোককে কেউ আগ্রহ করে কিছু বলবে না। গোলমাল একটু থামলে একজন ভালো লোককে বেছে নিয়ে সব ঘটনা খুঁটিয়ে জানতে হবে। গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে কোথায়?