জানকীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বুঝলাম, গল্প বলবার আসন্ন নেশায় তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেচেন। চুপ করে জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
জানকীবাবু বললেন–আজ প্রায় পঁচিশ বছর আমি সদিয়া অঞ্চলে ব্যাবসা করছি। পরশুরামপুর-তীর্থের নাম শুনেছেন?
খুব।
ঘন জঙ্গলের পাশে ওই তীর্থটা পড়ে। ওখান থেকে আরও সত্তর মাইল দূরে ভীষণ দুর্গম বনের মধ্যে আমি জঙ্গল ইজারা নিয়ে পাটের ব্যাবসা শুরু করি। ওখানে দফলা, মিরি, মিসমি এইসব নামের পার্বত্য-জাতির বাস। একদিন একটা বনের মধ্যে কুলিদের নিয়ে ঢুকেছি। জায়গাটার একদিকে ঝরনা, একদিকে উঁচু পাহাড়। তার গায়ে ঘন বাঁশবন। ওদিকে প্রায় সব পাহাড়েই বাঁশবন অত্যন্ত বেশি। কখনো গিয়েছেন ওদিকে?
আমি বললাম–না, তবে খাসিয়া পাহাড়ে এমন বাঁশবন দেখেচি, শিলং যাওয়ার পথে।
জানকীবাবুর গল্পটা আমি আমার নিজের ধরনেই বলি।
সেই পাহাড়ি-বাঁশবনে বন কাটবার জন্যে ঢুকে তাঁরা দেখলেন, এক জায়গায় একটা বড়ো শালগাছের নীচে আমাদের দেশের বৃষ-কাষ্ঠের মতো লম্বা ধরনের কাঠের খোদাই এক বিকট-মূর্তি দেবতার বিগ্রহ।
কুলিরা বললে–বাবু, এ মিসমিদের অপদেবতার মূর্তি, ওদিকে যাবেন না।
জানকীবাবুর সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, তাঁর শখ হল মূর্তিটার ফোটো নেবেন। কুলিরা বারণ করলে, জানকীবাবু তাদের কথায় কর্ণপাত না করে ক্যামেরা তেপায়ার উপর দাঁড় করিয়েছেন, এমন সময় একজন বৃদ্ধ মিসমি এসে তাদের ভাষায় কী বললে। জানকীবাবুর একজন কুলি সে ভাষা জানত। সে বললে–বাবু, ফোটো নিও না, ও বারণ করছে।
অন্য অন্য কুলিরাও বললে–বাবু, এরা জবর জাত–সরকারকে পর্যন্ত মানে না। ওদের দেবতাকে অপমান করলে গাঁ-সুদ্ধ তির ধনুক দিয়ে এসে হাজির হয়ে আমাদের সবগুলোকে গাছের সঙ্গে গেঁথে ফেলবে। ওরা দুনিয়ার কাউকে ভয় করে না, কারো তোয়াক্কা রাখে না– ওদের দেবতার ফোটো খিচবার দরকার নেই।
জানকীবাবু ক্যামেরা বন্ধ করলেন–এতগুলি লোকের কথা ঠেলতে পারলেন না। তারপর নিজের কাজকর্ম সেরে তিনি যখন জঙ্গল থেকে ফিরবেন, তখন আর-একবার সেই দেবমূর্তি দেখবার আগ্রহ হল।
সন্ধ্যার তখন বেশি দেরি নেই, পাহাড়ি-বাঁশবনের নিবিড় ছায়া-গহন পথে বন্য-জন্তুদের অতর্কিত আক্রমণের ভয়, বেণুবনশীর্ষে ক্ষীণ সূর্যালোক ও পার্বত্য-উপত্যকার নিস্তব্ধতা সকলের মনে একটা রহস্যের ভাব এনে দিয়েচে, কুলিদের বারণ সত্ত্বেও তিনি সেখানে গেলেন।
সবাই ভীত ও বিস্মিত হয়ে উঠল যখন সেখানে গিয়ে দেখলে, কোন সময় সেখানে একটি শিশু বলি দেওয়া হয়েছে। শিশুটির ধড় ও মুন্ড পৃথক পৃথক পড়ে আছে, কাঠে-খোদাই বৃষকাষ্ঠ-জাতীয় দেবতার পাদমূলে! অনেকটা জায়গা নিয়ে কাঁচা আধশুকনো রক্ত।
সেখানে সেদিন আর তাঁরা বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না।…
জানকীবাবু বললেন–আমার কী কুগ্রহ মশায়, আর যদি সেখানে না যাই তবে সবচেয়ে ভালো হয়, কিন্তু তা না করে আমি আবার পরের দিন সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। কুলিদের মধ্যে একজন লোক আমায় যথেষ্ট নিষেধ করেছিল, সে বলেছিল, বাবু, তুমি কলকাতার লোক, এসব দেশের গতিক কিছু জান না। জংলি-দেবতা হলেও ওদের একটা শক্তি আছে– তা তোমাকে ওদের পথে নিয়ে যাবে, তোমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করবে–ওখানে অত যাতায়াত কোরো না বাবু। কিন্তু কারো কথা শুনলাম না, গেলাম শেষপর্যন্ত। লুকিয়েই গেলাম, পাছে কুলিরা টের পায়।
কেন যে জানকীবাবু সেখানে গেলেন, তিনি তা আজও ভালো জানেন না।
কিংবা হয়তো রক্তপিপাসু বর্বর দেবতার শক্তিই তাঁকে সেখানে যাবার প্ররোচনা দিয়েছিল… কে জানে!
জানকীবাবু বললেন–ক্যামেরা নিয়ে যদি যেতাম, তাহলে তো বুঝতাম ফোটো নিতে যাচ্ছি–তাই বলেছিলাম, কেন যে সেখানে গেলাম, তা নিজেই ভালো জানি নে!
আমি বললাম–সে-মূর্তির ফোটো নিয়েছিলেন?
–না, কোনো দিনই না। কিন্তু তার চেয়ে খারাপ কাজ করেছিলাম, এখন তা বুঝতে পারচি।
জানকীবাবু যখন সেখানে গেলেন, তখন ঠিক থমথম করচে দুপুর বেলা, পাহাড়ি পাখিদের ডাক থেমে গিয়েছে, বনতল নীরব, বাঁশের ঝাড়ে ঝাড়ে শুকনো বাঁশের খোলা পাতা পড়বার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
দেবমূর্তির একেবারে কাছে যাবার অত্যন্ত লোভ হল–কারণ, কুলিরা সঙ্গে থাকায় এতক্ষণ তা তিনি করতে পারেননি।
গিয়ে দেখলেন, শিশুর শবের চিহ্নও সেখানে নেই। রাত্রে বন্যজন্তুতে খেয়েই ফেলুক, বা জংলিরাই নিজেরা খাবার জন্যে সরিয়ে নিয়ে যাক। অনেকক্ষণ তিনি মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন– কেমন এক ধরনের মোহ, একটা সুতীব্র আকর্ষণ! সত্যিকার নরবলি দেওয়া হয় যে দেবতার কাছে, এমন দেবতা কখনো দেখেননি বলেই বোধ হয় আকর্ষণটা বেশি প্রবল হল, কিংবা অন্য কিছু তা বলতে পারেন না তিনি।
সেই সময় এই কাঠের কবচখানা দেবমূর্তির গলায় ঝুলতে দেখে জানকীবাবু কিছু না ভেবে –চারিদিকে কেউ কোথাও নেই দেখে– সেখানা চট করে মূর্তিটার গলা থেকে খুলে নিলে।…
আমি বিস্মিতসুরে বললাম–খুলে নিলেন! কী ভেবে নিলেন হঠাৎ?
ভাবলাম একটা নিদর্শন নিয়ে যাব এদেশের জঙ্গলের দেবতার, আমাদের দেশের পাঁচজনের কাছে দেখাব! নরবলি খায় যে দেবতা, তার সম্বন্ধে যখন বৈঠকখানায় জাঁকিয়ে বসে গল্প করব তখন সঙ্গে সঙ্গে এখানা বার করে দেখাব। লোককে আশ্চর্য করে দেব, বোধ হয় এইরকমই একটা উদ্দেশ্য তখন থেকে থাকবে। কিন্তু যখন নিলাম গলা থেকে খুলে, তখনই মশায় আমার সর্বশরীর যেন কেঁপে উঠল। যেন মনে হল একটা কী অমঙ্গল ঘনিয়ে আসচে আমার জীবনে। ও-ধরনের দুর্বলতাকে কখনোই আমল দিইনি– সেটা খুলে নিয়ে পকেটজাত করে ফেললাম একবারে। মিসমিদের অনেকে এ-রকম কবচ গলায় ধারণ করে, সেটাও দেখেছি কিন্তু তারপরে। শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবার সময় বিশেষ করে এ-কবচ তারা পরবেই।