ওটা সম্পূর্ণ আন্দাজি-ব্যাপার! কোনো জায়গায় যখন খুঁজে পেলাম না তখন মনে পড়ল, ওই জঙ্গলে দাঁতন ভেঙেছিলাম, তখন পকেট থেকে পড়ে যেতে পারে। তাই–
আমি ওঁর মুখে একটা ভয়ের চিহ্ন পরিস্ফুট হতে দেখলাম। বললাম–সব কথা খুলে বলুন। আমি এখনও আপনার সব কথা শুনিনি! তবে আপনার মুখ দেখে তা বুঝতে পারছি।
জানকীবাবু ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলেন, যেন তাঁর গোপনীয় কথা শুনবার জন্যে জেলে সেই ক্ষুদ্র কামরার মধ্যে কেউ লুকিয়ে ওৎ পেতে বসে রয়েছে। তাঁর এ ভাব পরিবর্তনে আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ভয়ে দুঃখে লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি?
আমায় বললেন–ওখানা এখন কোথায়?
একজিবিট হিসেবে কোর্টেই জমা আছে।
তারপর কে নিয়ে নেবে?
আপনার সম্পত্তি, আপনার ওয়ারিশান কোর্টে দরখাস্ত করলে–
জানকীবাবু ভয়ে যেন কোনো অদৃশ্য শত্রুকে দু-হাত দিয়ে ঠেলে দেবার ভঙ্গিতে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন–না না আমি ও চাইনে, আমার ওয়ারিশান কেউ নেই, ও আমি চাইনে–ওই সর্বনেশে কবচই আমাকে আজ এ-অবস্থায় এনেচে। আপনি জানেন না ও কী!
এই পর্যন্ত বলে তিনি চুপ করে গেলেন। যেন অনেকখানি বেশি বলে ফেলেচেন– যা বলবার ইচ্ছে ছিল তার চেয়েও বেশি। আর তিনি কিছু বলতে চান না বা ইচ্ছে করেন না।
আমি বললাম–আপনি যদি না নিতে চান, আমি কাছে রাখতে পারি।
আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে জানকীবাবু বললেন–আপনি সাহস করেন?
এর মধ্যে সাহস করবার কী আছে? আমায় দেবেন।
আপনি আমায় পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন, আপনি আমার শত্রু–তবুও এখন ভেবে দেখচি, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন আপনি! আপনার ওপর আমার রাগ নেই। আমি আপনাকে বন্ধুর মতো পরামর্শ দিচ্চিও-কবচ আপনি কাছে রাখতে যাবেন না।
কেন?
সে-অনেক কথা। সংক্ষেপে বললাম–ও-জিনিসটা দূরে রেখে চলবেন।
আমি যেজন্যে আজ জানকীবাবুর কাছে এসেছিলাম, সে উদ্দেশ্য সফল হতে চলেছে। আমি এসেছিলাম আজ ওঁর মুখে কবচের ইতিহাস কিছু শুনব বলে। আমার ওভাবে কথা পাড়বার মূলে এই একটা উদ্দেশ্য ছিল। অনুনয়ের সুরে কোনো কথা বলে জানকীবাবুর কাছে কাজ আদায় করা যাবে না এ আমি আগেই বুঝেছিলাম, সুতরাং আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম–আমার কোনো কুসংস্কার নেই জানবেন।
জানকীবাবু খোঁচা খেয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে বললেন–কুসংস্কার কাকে বলেন আপনি?
আপনার মতো ওইসব মন্ত্র-তন্ত্র-কবচে বিশ্বাস–ওর নাম যদি কুসংস্কার না হয়, তবে কুসংস্কার আর কাকে বলব?
জানকীবাবু ক্রোধের সুরে বললেন–আপনি হয়তো ভালো ডিটেকটিভ হতে পারেন, কিন্তু দুনিয়ার সব জিনিসই তা বলে আপনি জানবেন?
আমি পূর্বের মতো তাচ্ছিল্যের সুরেই বললাম–আমার শিক্ষাগুরু একজন আছেন, তাঁর বাড়িতে ওরকম একখানা কবচ আছে।
কে তিনি?
মি. সোম, বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ।
যিনিই হোন, আমার তা জানবার দরকার নেই। একটা কথা আপনাকে বলি। যদি আপনি তাঁর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হন, তবে অবিলম্বে তাঁকে বলবেন সেখানা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে। কতদিন থেকে তাঁর সঙ্গে সেখানা আছে, জানেন।
তা জানিনে, তবে খুব অল্পদিনও নয়। দু-তিন বছর হবে।
আর আমার সঙ্গে এ-কবচ আছে সাত বছর। কিন্তু থাকগে।
বলেই জানকীবাবু চুপ করলেন। আর যেন তিনি মুখই খুলবেন না, এমন ভাব দেখালেন।
আমি বললাম–বলুন, কী বলতে চাইছিলেন?
অন্য কিছু নয়, ও-কবচখানা আপনি আপনার গুরুকে টান মেরে ভাসিয়ে দিতে বলবেন– আর, এখানাও আপনি কাছে রাখবেন না।
আমি তো বলেচি আমার কোনো কুসংস্কার নেই।
অভিজ্ঞতা দ্বারা যা জেনেছি, তাকে কুসংস্কার বলে মানতে রাজি নই। বেশি তর্ক আপনার সঙ্গে করব না। আপনি থাকুন কী উচ্ছন্নে যান, তাতে আমার কী?
এই যে খানিক আগে বলেছিলেন, আমার ওপর আপনার কোনো রাগ নেই?
ছিল না, কিন্তু আপনার নির্বুদ্ধিতা আর দেমাক দেখে রাগ হয়ে পড়েছে।
দেমাক দেখলেন কোথায়? আপনি তো কোনো কারণ দেখাননি। শুধুই বলে যাচ্ছেন– কবচ ফেলে দাও। আজকাল কোনো দেশে এসব মন্ত্রে-তন্ত্রে বিশ্বাস করে ভেবেচেন? একখানা কাঠের পাত মানুষের অনিষ্ট করতে পারে বলে আপনিও বিশ্বাস করেন?
আমিও আগে ঠিক এই কথাই ভাবতাম, কিন্তু এখন আমি বুঝেছি। কিন্তু বুঝেছি এমন সময় যে, যখন আর কোনো চারা নেই।
জিনিসটা কী, খুলে বলুন না দয়া করে!
শুনবেন তবে? ওই কবচই আমার এই সর্বনাশের কারণ। আমি বুঝেছিলাম এ-সম্বন্ধে জানকীবাবু কী একটা কথা আমার কাছে চেপে যাচ্ছেন। আগে একবার বলতে গিয়েও বলেননি, হঠাৎ গুম খেয়ে চুপ করে গিয়ে অন্য কথা পেড়েছিলেন। এবার হয়তো তার পুনরাবৃত্তি করবেন।
সুতরাং, আমি যেন তাঁর আসল কথার অর্থ বুঝতে পারিনি এমন ভাব দেখিয়ে বললাম– তা বটে। একদিক থেকে দেখতে হলে, ওই কবচখানাই তো আপনার বর্তমান অবস্থার জন্যে দায়ী।
জানকীবাবু আমার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন–আপনি কী বুঝেছেন, বলুন তো? কীভাবে দায়ী।
মানে, ওখানা না হারিয়ে গেলে তো আপনি আজ ধরা পড়তেন না–যদি ওখানা পকেট থেকে না পড়ে যেত?
কিছুই বোঝেননি।
এ-ছাড়া আর কী বোঝবার আছে?
আজ যে আমি একজন খুনি, তাও জানবেন ওই সর্বনেশে কবচের জন্যে। কবচ যদি আমার কাছে না থাকত তবে আজ আমি একজন মার্চেন্ট হতে পারে ব্যাবসাতে লোকসান দিয়েছিলাম–কিন্তু ব্যাবসা করতে গেলে লাভ-লোকসান কার না হয়? আমার বুকে সাহস ছিল, লোকসান আমি লাভে দাঁড় করাতে পারতাম। কিন্তু ওই কবচ তা আমায় করতে দেয়নি। ওই কবচ আমার ইহকাল-পরকাল নষ্ট করেছে!