আমি এর জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম।
বরং জানকীবাবুই আমার যুযুৎসুর আড়াই-পেঁচির ছুটের জন্যে তৈরি ছিলেন না।
তিনি হাতের মাপের অন্তত তিন হাত দূর ছিটকে পড়ে হাঁপাতে লাগলেন।
আমি হেসে বললাম–এ লাইনে যখন নেমেচেন, তখন অন্তত দু-একটা প্যাঁচ জেনে রাখা আপনার নিতান্ত দরকার ছিল জানকীবাবু। কবচ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেন না। কবচ আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন এটা আমার হাতে। এখন ভাগ্যদেবী আমায় দয়া করবেন।
কী বলছেন আপনি?
একথার জবাব দেবেন অন্য জায়গায়। দাঁড়ান একটু এখানে।
থানার দারোগাবাবু কাছেই ছিলেন, আমার ইঙ্গিতে তিনি এসে হাসিমুখে বললেন–দয়া করে একটু এগিয়ে আসুন জানকীবাবু! খুনের অপরাধে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করলাম। …এই, লাগাও!
কনস্টেবলরা এগিয়ে গিয়ে জানকীবাবুর হাতে হাতকড়ি লাগাল।
জানকীবাবু কী বলতে চাইলেন। দারোগাবাবু বললেন–আপনি এখন যা-কিছু বলবেন, আপনার বিরুদ্ধে তা প্রয়োগ করা হবে, বুঝেসুঝে কথা বলবেন।
জানকীবাবুর বিরুদ্ধে পুলিশ আরও অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করে। গাঙ্গুলিমশায় খুন হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যে তিনি জেলার লোন-অফিস ব্যাংকে সাড়ে ন-শো টাকা জমা রেখেছেন, পুলিশের থানা-তল্লাশিতে তার কাগজ বার হয়ে পড়ল।
তারপর বিচারে জানকীবাবুর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
একটা বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল জানবার। জানকীবাবুর সঙ্গে আমি জেলের মধ্যে দেখা করলাম। তখন তাঁর প্রতি দন্ডাদেশ হয়ে গিয়েছে।
আমাকে দেখে জানকীবাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম–কেমন আছেন জানকীবাবু?
ধন্যবাদ! কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে হবে না আপনাকে।
একটু বেশি রাগ করেচেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমায় কর্তব্য পালন করতে হয়েছে, তা বুঝতেই পারছেন।
থাক ওতেই হবে।
দেখুন জানকীবাবু, মনের অগোচর পাপ নেই। আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন, আপনি কতদূর হীন কাজ করেছেন। একজন অসহায়, সরল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ–যিনি আপনাকে গাঁয়ের জামাই জেনে আপনার প্রতি আত্মীয়ের মতো–এমনকী, আপনার শ্বশুরের মতো ব্যবহার করতেন, আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে তাঁর টাকাকড়ির হিসেব আপনাকে দিয়ে লেখাতেন –তাঁকে আপনি খুন করেছেন। পরকালে এর জবাবদিহি দিতে হবে যখন, তখন কী করবেন ভাবলেন না একবার?
মশায়, আপনাকে পাদ্রি-সাহেবের মতো লেকচার দিতে হবে না। আপনি যদি এখনই এখান থেকে না যান–আমি ওয়ার্ডারকে ডেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেব–বিরক্ত করবেন না।
লোকটা সত্যিই অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির। নররক্তে হাত কলুষিত করেছে, অথচ এখন মনে অনুতাপের অঙ্কুর পর্যন্ত জাগেনি ওর।
আমি বললাম–আপনি সংসারে একা, ছেলেপুলে নেই, স্ত্রী নেই। তাঁরা স্বর্গে গিয়েছেন, কিন্তু আপনার এই কাজ স্বর্গ থেকে কি তাঁরা দেখবেন না আপনি ভেবেচেন? তাঁদের কাছে মুখ দেখাবেন কী করে?
জানকীবাবু চুপ করে রইলেন এবার। আমি ভাবলুম, ওষুধ ধরেচে। আগের-কথাটা আরও সুস্পষ্টভাবে বললাম। জানি না আজ জানকীবাবুর হৃদয়ের নিভৃত কোণে তাঁর পরলোকগত স্ত্রী-পুত্রের জন্য এতটুকু স্নেহপ্রীতি জাগ্রত আছে কিনা! কিন্তু আমার যতদূর সাধ্য তাঁর মনের সে দিকটাতে আঘাত দেবার চেষ্টা করলাম–বহুদিনের মরচেপড়া হৃদয়ের দোর যদি এতটুকু খোলে!
বললাম–ভেবে দেখুন জানকীবাবু, আপনার কাছে কত পবিত্র স্মৃতির আধার হওয়া উচিত যে গ্রাম, সেই গ্রামে বসে আপনি নরহত্যা করেছেন–এ যে কত পাপের কাজ তা যদি আজও বোঝেন, তবুও অনুতাপের আগুনে হৃদয় শুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। অনুতাপে মানুষকে নিষ্পাপ করে, মহাপুরুষেরা বলেছেন। আপনি বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, মহাপুরুষদের বাণী তা বলে মিথ্যা হয়ে যাবে না।
জানকীবাবু আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন–মশায়, আপনি কী কাজ করেন? এই কি আপনার পেশা?
খারাপ পেশা নয় তা স্বীকার করবেন বোধ হয়!
খারাপ আর কী!
দোষীকে প্রায়শ্চিত্ত করবার সুবিধে করে দিই, যাতে তার পরকালে ভালো হয়।
আচ্ছা, এ আপনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন?
নিশ্চয়ই করি।
তবে শুনুন বলি, বসুন।
বেশ কথা, বলুন।
আমার দ্বারাই এ-কাজ হয়েছে।
অর্থাৎ গাঙ্গুলিমশায়কে আপনি…
ও-কথা আর বলবেন না।
বেশ। কেন করলেন?
সে অনেক কথা। আমার উপায় ছিল না।
কেন?
আমি ব্যাবসা করতুম শুনেচেন তো? ব্যাবসা ফেল পড়ে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলাম, চারিদিকে দেনা। লোভ সামলাতে পারলাম না।
আপনার সান্ত্বনা আপনার কাছে। কিন্তু এটা লাগসই কৈফিয়ৎ হল না।
আমি তা জানি। দুর্বল মন আমাদের–কিন্তু আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বড়ো ইচ্ছে হয়।
স্বচ্ছন্দে বলুন।
আপনি ওই কবচখানা পেয়েছিলেন যেদিন, সেদিন আপনি বুঝতে পেরেছিলেন ওখানা কী?
না।
কবে পারলেন?
আমার শিক্ষাগুরু মি. সোমের কাছে কবচের বিষয় সব জেনেছিলাম। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
বলুন!
আপনি কেন আবার এ-গ্রামে এসেছিলেন, খুনের পরে?
আপনি নিশ্চয়ই তা বুঝেছেন।
আন্দাজ করেছি। কবচখানা হারিয়ে গিয়েছিল খুনের রাত্রেই–সেখানা খুঁজতে এসেছিলেন।
ঠিক তাই।
সেদিন গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে অন্ধকারে ওটা খুঁজছিলেন কেন, দিনমানে না খুঁজে?
দিনেই খুঁজতে শুরু করেছিলাম, রাত হয়ে পড়ল।
ওখানেই যে হারিয়েছিলেন, তা জানলেন কী করে?