সে ভাববেন না, যদি আপনার সংগৃহীত প্রমাণের জোর থাকে, তবে বাকি সব আমি করে নেব। এই কাজ করচি আজ সতেরো বছর।
আমি গ্রামে ফিরে একদিনও চুপ করে বসে রইলাম না। এসব ব্যাপারে দেরি করতে নেই, করলেই ঠকতে হয়। জানকীবাবুর শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করলাম। শুনলাম, জানকীবাবু মাছ ধরতে গিয়েছেন কোথাকার পুকুরে–আর মাত্র দু-দিন তিনি এখানে আছেন–এই দু-দিনের মধ্যেই সব বন্দোবস্ত করে ফেলতে হবে।
আমি বললাম–দিদিমা, জানকীবাবু আপনাকে কিছু কিছু টাকা পাঠান শুনেচি?
না দাদা, ও-কথা কার কাছে শুনেচ? জামাই তেমন লোকই নয়।
পাঠান না?
আরও উলটে নেয় ছাড়া দেয় না। মেয়ে থাকতে তবুও যা দিত, এখন একেবারে উপুড় হাতটি করে না কোনোদিন।
যাক চিঠিপত্র দিয়ে খোঁজখবর নেন তো–তাহলে হল।
তাও কখনো কখনো। বছরে একবার বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে একখানা লেখে।
খাম, না পোস্টকার্ড?
হ্যাঁ, খাম না রেজিস্টারি চিঠি। তুমিও যেমন দাদা! মেয়ে বেঁচে না থাকলেই জামাই পর হয়ে যায়। তার উপর কি কোনো দাবি থাকে দাদা? দু-লাইন লিখে সেরে দেয়।
কই, দেখি? আছে নাকি চিঠি?
ওই চালের বাতায় গোঁজা আছে, দেখো না।
খুঁজে খুঁজে নাম দেখে একখানা পুরোনো পোস্টকার্ড চালের বাতা থেকে বের করে বৃদ্ধাকে পড়ে শোনালুম। বৃদ্ধা বললেন–ওই চিঠি দাদা।
আরও দু-একটা কথা বলে চিঠিখানা নিয়ে চলে এলাম সঙ্গে করে। জানকীবাবু যদি একথা এখন শুনতেও পান যে, তাঁর লেখা চিঠি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, তাতেও আমার কোনো ক্ষতির কারণ নেই।
থানায় দারোগার সামনে বসে হাতের লেখা দুটো মেলানে হল।
অদ্ভুত ধরনের মিল। দু-একটা অক্ষর লেখার বিশেষ ভঙ্গিটা উভয় হাতের লেখাতেই একইরকম।
.
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
দারোগাবাবু বললেন–তবুও একজন হাতের লেখা-বিশেষজ্ঞের মত নেওয়া দরকার নয় কি?
সে তো কোর্টে প্রমাণের সময়। এখন ওসব দরকার নেই। আপনি সন্দেহক্রমে চালান দিন।
আমায় অন্য কারণগুলো সব বলুন।
একে-একে সব বলব–তার আগে একবার কলকাতায় যাওয়া দরকার।
মি. সোমের সঙ্গে দেখা করলাম কলকাতায়। সব বললাম তাঁকে খুলে।
তিনি বললেন–একটা কথা বলি। তোমাদের সাক্ষীসাবুদ প্রমাণ-সূত্রাদির চেয়েও একটা বড়ো জিনিস আছে। এটা সূত্র ধরে অপরাধী বের করতে বড় সাহায্য করে। অন্তত আমায় তো অনেকবার যথেষ্ট সাহায্য করেছে। সেটা হল–অঙ্কশাস্ত্র। অঙ্ক, Chance-এর আঁক কষে বোঝা যায় যে, একজন লোক যে আসামে থাকে বলবে, অথচ দাঁতন করবে, অথচ তার হাতের লেখার সঙ্গে যাকে সন্দেহ করা হচ্চে তার হাতের লেখার হুবহু মিল থাকবে, এ ধরনের ব্যাপার হয়তো তিন হাজারের মধ্যে একটা ঘটে। এক্ষেত্রে যে সে-রকম ঘটেছে, এমন মনে করবার কোনো কারণ নেই–সুতরাং ধরে নিতে হবে ও সেই লোকই।
সেদিন কলকাতা থেকে চলে এলাম। আসবার সময় একবার থানার দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বললেন, আপনি লোক পাঠালেই আমি সব ব্যবস্থা করব।
ওয়ারেন্ট বার হয়েছে?
এখনও হস্তগত হয়নি, আজ-কাল পেয়ে যাব।
গ্রামে ফিরে দু-তিন দিন চুপচাপ বসে রইলাম শ্রীগোপালের বাড়িতে। খবর নিয়ে জানলাম, জানকীবাবু দু-একদিনের মধ্যেই এখান থেকে চলে যাবেন। থানার দারোগার কাছে চিঠি দিয়ে আসতে বলে দিলাম।
পকেটে মিসমিদের কবচখানা রেখে আমি জানকীবাবুর সন্ধানে ফিরতে থাকি এবং একটু পরে পেয়েও যাই। জানকীবাবুকে কৌশল করে নির্জনে গাঁয়ের মাঠের দিকে নিয়ে গেলাম।
আজ একবার শেষ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। হয় এসপার, নয় ওসপার!
জানকীবাবু বললেন–আপনার কাজ কতদূর এগোলো?
এক পাও না। আপনি কী বলেন?
আমি তো ভাবচি, ননীর সম্বন্ধে থানায় গিয়ে বলব।
সন্দেহের কারণ পেয়েছেন?
না পেলে কি আর বলচি?
আচ্ছা জানকীবাবু, আপনি বুঝি আসামে ছিলেন?
কে বললে?
আমি শুনলাম যেন সেদিন কার মুখে।
না, আমি কখনো আসামে ছিলাম না। যিনি বলেচেন, তিনি জানেন না।
আমার মনে ভীষণ সন্দেহ হল। জানকীবাবু একথা বলতে চান কেন? তবে কি তিনি মিসমিদের কবচ হারানো এবং বিশেষ করে সেখানা যদি আমার হাতে পড়ে বা পুলিশের কোনো সুযোগ্য ডিটেকটিভের হাতে পড়ে তবে তার গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত?
আমি তখন আমার কর্তব্য স্থির করে ফেলেচি। বললাম।–মানে, অন্য কেউ বলেনি, আপনার দেওয়া একটা পাতার টোকা সেদিন আপনার শ্বশুরবাড়িতে দেখে ভাবলাম এ টোকা আসাম সদিয়া অঞ্চল ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না–মিসমিদের দেশে অমন টোকার ব্যবহার আছে।
আপনার ভুল ধারণা।
আমি তাঁর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে পকেট থেকে মিসমিদের কাঠের কবচখানা বের করে তাঁর সামনে ধরে বললাম–দেখুন দিকি এ জিনিসটা কী? … চেনেন? যে-রাত্রে গাঙ্গুলিমশায় খুন হন, সে-রাত্রে তাঁর বাড়ির পেছনে এটা কুড়িয়ে পাই। আসামে মিসমিজাতের মধ্যে এই ধরনের কাঠের কবচ পাওয়া যায় কিনা–তাই।
আমার খবরের সঙ্গেসঙ্গে জানকীবাবুর মুখ সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেল–কিন্তু অত্যন্ত অল্পকালের জন্যে। পরমুহূর্তেই ভীষণ ক্রোধে তাঁর নাক ফুলে উঠল, চোখ বড়ো বড়ো হল। হঠাৎ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লেন বাঘের মতো এবং সঙ্গেসঙ্গে কবচ-সুদ্ধ হাতখানা চেপে ধরে জিনিসটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি দু-হাতেই আমার গলা চেপে ধরলেন পাগলের মতো।