জানকীবাবুর শ্বশুরবাড়ি শ্রীগোপালের বাড়ির পাশেই।
ওর বৃদ্ধা শাশুড়ি, দেখি বাইরের রোয়াকে বসে মালা জপ করছেন। আমি তাঁকে আরও জিজ্ঞেস করবার জন্যে সেখানে গিয়ে বসলাম।
বুড়ি বললে–এসো দাদা, বোসো।
ভালো আছেন, দিদিমা?
আমাদের আবার ভালোমন্দ–তোমরা ভালো থাকলেই আমাদের ভালো।
আপনি বুঝি একাই থাকেন?
আর কে থাকবে বল–আছেই-বা কে? এক মেয়ে ছিল, মারা গিয়েছে।
তবে তো আপনার বড়ো কষ্ট, দিদিমা!
কী করব দাদা, অদেষ্টে দুঃখ থাকলে কেউ কি ঠেকাতে পারে?
আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বুড়ির সামনের গোয়ালের ছিটেবেড়ায় একটা অদ্ভুত জিনিস রয়েছে–জিনিসটা হচ্ছে, খুব বড়ো একটা পাতার টোকা। পাতাগুলো শুকনো তামাক-পাতার মতো ঈষৎ লালচে। পাতার বোনা ওরকম টোকা, বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ে কখনো দেখিনি।
জিজ্ঞেস করলাম–দিদিমা, ও জিনিসটা কী? এখানে তৈরি হয়?
বৃদ্ধা বললেন–ওটা এ-দেশের নয় দাদা!
কোথায় পেয়েছিলেন ওটা?
আমার জামাই এনে দিয়েছিল।
আপনার জামাই? জানকীবাবু বুঝি?
হ্যাঁ দাদা। ও আসামে চ-বাগানে থাকত কিনা, ওই আর বছর এনেছিল।
হঠাৎ আমার মনে কেমন একটা খটকা লাগল… আসাম! …চা বাগান! এই ক্ষুদ্র গ্রামের সঙ্গে সুদূর আসামের যোগ কীভাবে স্থাপিত হতে পারে–এ আমার নিকট একটা মস্ত-বড়ো সমস্যা। একটা ক্ষীণ সূত্র মিলেছে।
আমি বললাম–জানকীবাবু বুঝি আসামে থাকতেন?
হ্যাঁ দাদা, অনেকদিন ছিল। এখন আর থাকে না। আমার সে-মেয়ে মারা গিয়েছে কিনা! তবু জামাই মাঝে মাঝে আসে। গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে বড়ো ভাব ছিল। এলেই ওখানে বসে গল্প, চা খাওয়া–
ও!
বুড়ো খুন হয়েছে শুনে জামাইয়ের কী দুঃখু!
গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর ক-দিন পরে এলেন উনি?
তিন-চার দিন পরে দাদা!
আপনার মেয়ে মারা গিয়েছেন কতদিন হল দিদিমা?
তা, বছর-তিনেক হল–এই শ্রাবণে।
মেয়ে মারা যাওযার পর উনি যেমন আসছিলেন, তেমনই আসতেন, না, মধ্যে কিছুদিন আসা বন্ধ ছিল?
বছর-দুই আর আসেনি। মন তো খারাপ হয়, বুঝতেই পার দাদা! তারপর এল একবার শীতকালে। এখানে রইল মাসখানেক। বেশ মন লেগে গেল। সেই থেকে প্রায়ই আসে।
আমি বৃদ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সেদিন আর কোথাও বেরোলাম না। পরদিন সকালে উঠে স্থির করলাম একবার থানার দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। বিশেষ আবশ্যক।
পথেই জানকীবাবুর সঙ্গে দেখা। আমায় জিজ্ঞেস করলেন–এই যে! বেড়াচ্ছেন বুঝি?
আমি বললাম–চলুন, ঘুরে আসা যাক একটু। আপত্তি আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, চলুন না যাই।
আচ্ছা জানকীবাবু, আপনি মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাস করেন?
হ্যাঁ, খানিকটা করিও বটে, খানিকটা নাও বটে। কেন বলুন তো?
আমার নিজের ওতে একেবারেই বিশ্বাস নেই। তাই বলছি। আপনি তো অনেক দেশ ঘুরেচেন, আপনার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি।
হঠাৎ জানকীবাবু আমার চোখের সামনে এমন একটা কান্ড করলেন, যাতে আমি স্তম্ভিত ও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্যে।
.
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
কান্ডটা এমন কিছুই নয়, খুবই সাধারণ।
জানকীবাবু পথের পাশে ঝোঁপের জঙ্গলের দিকে চেয়ে বললেন–দাঁড়ান, একটা দাঁতন ভেঙেনি। সকাল বেলাটা..
তারপর তিনি আমার সামনে পথের ধারে একটা শ্যাওড়াডাল ঘুরিয়ে ভেঙে নিলেন দাঁতনকাঠির জন্যে।
আমার ভাবান্তর অতি অল্পক্ষণের জন্যে।
পরক্ষণেই আমি সামলে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সহজভাবে কথাবার্তা বলতে শুরু করলাম।
ঘণ্টাখানেক পরে ঘুরে এসে আমি ভাঙা-শ্যাওড়াডালটা ভালো করে লক্ষ করে দেখি, সঙ্গে সেদিনকার সেই দাঁতনকাঠির শুকনো গোড়াটা এনেছিলাম।
যে বিশেষ ভঙ্গিতে আগের গাছটা ভাঙা হয়েছে, এটাও অবিকল তেমনি ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাঙা!
কোনো তফাত নেই।
আমার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছিল। আসাম, দাঁতনকাঠি–দুটো অতিসাধারণ, অথচ অত্যন্ত অদ্ভুত সূত্র।
জানকীবাবুর এখানে গত এক বছর ধরে ঘনঘন আসা-যাওয়া, পত্নীবিয়োগ সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়ি আসার তাগিদ, গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব!
মি. সোম একবার আমায় বলেছিলেন, অপরাধী বলে যাকে সন্দেহ করবে, তখন তার পদমর্যাদা বা বাইরের ভদ্রতা–এমনকী, সম্বন্ধ, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদিকে আদৌ আমল দেবে না।
জানকীবাবুর সম্বন্ধে আমার গুরুতর সন্দেহ জাগল মনে।
একটা সূত্র এবার অনুসন্ধান করা দরকার। অত্যন্ত দরকারি একটা সূত্র।
সকালে উঠে গিয়ে দারোগার সঙ্গে দেখা করলাম থানায়।
দারোগাবাবু আমায় দেখে বললেন–কী? কোনো সন্ধান করা গেল?
করে ফেলেছি প্রায়। এখন–যে-খাতার পাতাখানা আপনার কাছে আছে, সেই খানা একবার দরকার।
ব্যাপার কী, শুনি?
এখন কিছু বলচিনে! হাতের লেখা মেলানোর ব্যাপার আছে একটা।
কীরকম?
গাঙ্গুলিমশায়ের খাতা লিখত যে-ক-জন–তাদের সবার হাতের লেখা জানি, কেবল একটা হাতের লেখার ছিল অভাব–তাই না?
সে তো আমিই আপনাকে বলি।
এখন সেই লোক কে হতে পারে, তার একটা আন্দাজ করে ফেলেচি। তার হাতের লেখার সঙ্গে এখন সেই পাতার লেখাটা মিলিয়ে দেখতে হবে।
লোকটার বর্তমান হাতের লেখা পাওয়ার সুবিধে হবে?
জোগাড় করতে চেষ্টা করছি। যদি মেলে, আমি সন্দেহক্রমে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবো।
আমায় বলবেন, আমি গিয়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসব ওয়ারেন্ট বের করিয়ে নিতে যা দেরি।
বাকিটুকু কিন্তু আপনাদের হাতে।