তাড়াতাড়ি উঠে টর্চ জ্বেলে দেখি, বিছানা রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। তখুনি নেকড়া ছিঁড়ে হাতে জলপটি বেঁধে লণ্ঠন জ্বালোম।
লাঠির অগ্রভাগে তীক্ষাস্ত্র ছোরা বাঁধা ছিল–আমার বুক লক্ষ করে ঠিক কুড়লের কাপের ধরনে লাঠি উঁচিয়ে কোপ মারলেই ছোরা পিঠের ওদিক দিকে ছুঁড়ে বেরোতো। তারপর বাঁধন আলগা করে ছোরাখানা আমার বিছানার পাশে কিংবা আমার ওপর ফেলে রাখলেই আমি যে আত্মহত্যা করেচি, একথা বিশেষজ্ঞ ভিন্ন অন্য লোককে ভুল করে বোঝানো চলত।
আমি নিরস্ত্র ছিলাম না–মি. সোমের ছাত্র আমি। আমার বালিশের তলায় ছ-নলা অটোমেটিক ওয়েবলি লুকোনো। সেটা হাতে করে তখুনি বাইরে এসে টর্চ ধরে ঘরের সর্বত্র খুঁজলাম–জানালার কাছে জুতোসুদ্ধ টাটকা পায়ের দাগ।
ভালো করে টর্চ ফেলে দেখলাম।
কী জুতো? … রবার-সোল, না, চামড়া? … অন্ধকারে ভালো বোঝা গেল না।
এখুনি এই জুতোর সোলের একটা ছাঁচ নেওয়া দরকার। কিন্তু তার কোনো উপকরণ দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ আমার কাছে নেই।
আমার মনে কেমন ভয় করতে লাগল, আকাশের দিকে চাইলাম। কৃষ্ণপক্ষের ঘোর মেঘান্ধকার রজনী।
এমনি রাত্রে ঠিক গত কৃষ্ণপক্ষেই গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েছিলেন।
আমি শ্রীগোপালের বাড়ি গিয়ে ডাকলাম–শ্রীগোপাল, শ্রীগোপাল, ওঠো–ওঠো!
শ্রীগোপাল জড়িত-কণ্ঠে উত্তর দিলে–কে?
–বাইরে এসো–আলো নিয়ে এসো–সব বলছি।
শ্রীগোপাল একটা কেরোসিনের টেমি জ্বালিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বিস্মিতমুখে বার হয়ে এসে বললে–কে? ও, আপনি? এত রাত্রে কী মনে করে?
চলো বসি–সব বলছি। এক গ্লাস জল খাওয়াও তো দেখি!
চা খাবেন? স্টোভ আছে। চা-খোর আমি, সব মজুত রাখি–করে দিই।
চা খেয়ে আমি আর বসতে পারছি না। ঘুমে যেন চোখ ঢুলে আসচে! শ্রীগোপাল বললে– বাকি রাতটুকু আমার এখানেই শুয়ে কাটিয়ে দেবেন-এখন।
ব্যাপার সব শুনে শ্রীগোপাল বললে–এর মধ্যে ননী আছে বলে মনে হয়। এ তারই কাজ।
না।
না? বলেন কী?
না, এ ননীর কাজ নয়।
কী করে জানলেন?
এখানকার লোক ছোরার ব্যবহার জানে না–বাংলা দেশের পাড়াগাঁয়ে ছোরার ব্যবহার নেই।
তবে?
এ-কাজ যে করেচে সে বাংলার বাইরে থাকে। তুমি কাউকে রাতের কথা বোলো না কিন্তু!
আপনাকে খুন করতে আসার উদ্দেশ্য?
আমি দোষী খুঁজে বার করবার কাজে পুলিশকে সাহায্য করচি–এ ছাড়া আর অন্য কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
.
ভোর হল। আমি উঠে আমার ঘরে চলে গেলাম।
জানলার বাইরে সেই পায়ের দাগ তেমনি রয়েছে। রবার-সোলের জুতো বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্চে। ক-নম্বরের জুতো তাও জানা গেল।
বিকেলে আমি ভাবলাম, একবার মামার বাড়ি যাব। এ-গ্রামে ডাক্তার নেই ভালো–মামার বাড়ি গিয়ে আমার ক্ষতস্থানটা দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে আসব। ঘরের মধ্যে জামা গায়ে দিতে মনে হল–আমার ঘরের মধ্যে কে যেন ঢুকেছিল।
কিছুই থাকে না ঘরে। একটা ছোটো চামড়ার সুটকেস–তাতে খানকতক কাপড়-জামা। কে ঘরের মধ্যে ঢুকে সুটকেসটা মেঝেতে ফেলে তার মধ্যে হাতড়ে কী খুঁজেচে-কাপড় জামা, বা, একটা মানিব্যাগে গোটা-দুই টাকা ছিল যেগুলি ছোঁয়নি। বালিশের তলা–এমনকী, তোশকটার তলা পর্যন্ত খুঁজেছে।
আমি প্রথমটা ভাবলাম, এ কোনো ছিঁচকে চোরের কাজ। কিন্তু চোর টাকা নেয়নি–তবে কি, রিভলবারটা চুরি করতে এসেছিল? সেটা আমার পকেটেই আছে অবশ্যি–সে উদ্দেশ্য থাকা বিচিত্র নয়।
জানকীবাবুকে ডেকে সব কথা বললাম। জানকীবাবু শুনে বললেন–চলুন, জায়গাটা একবার দেখে আসি।
ঘরে ঢুকে আমরা সব দিক ভালো করে খুঁজে দেখলাম। সব ঠিক আছে। জানকীবাবু আমার চেয়েও ভালো করে খুঁজলেন, তিনিও কিছু বুঝতে পেরেছেন বলে মনে হল না।
বললাম–দেখলেন তো?
টাকাকাড়ি কিছু যায়নি?
কিছু না।
আর কোনো জিনিস আপনার ঘরে ছিল?
কী জিনিস?
অন্য কোনো দরকারি–ইয়ে–মানে–মূল্যবান?
এখানে মূল্যবান জিনিস কী থাকবে?
তাই তো!
হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ল। মিসমিদের সেই কবচ আর দাঁতনকাঠির টুকরোটা আমি এই ঘরে কাল পর্যন্ত রেখেছিলাম, কিন্তু কাল কী মনে করে শ্রীগোপালের বাড়ি যাবার সময় সে-জিনিস দু-টি আমি পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিলাম–এখনও পর্যন্ত সে দু-টি আমার পকেটেই আছে। কিন্তু কথাটা জানকীবাবুকে বলি বলি করেও বলা হল না।
জানকীবাবু যাবার সময় বললেন–ননীর ওপর আপনার সন্দেহ হয়?
হয় খানিকটা।
একবার ওকে ডাকিয়ে দেখি।
এখন নয়। আমি মামার বাড়ি যাই, তারপর ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন।
কিছুক্ষণ পরে আমি জানকীবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মামার বাড়ি চলে এলাম।
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
আমার মামার বাড়ির পাশে সুরেশ ডাক্তারের বাড়ি। সে আমার সমবয়সি–গ্রামে প্র্যাকটিস করে। মোটামুটি যা রোজগার করে, তাতে তার চলে যায়। ওর কাছে ক্ষতস্থান ধুইয়ে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে আবার শ্রীগোপালদের গ্রামেই ফিরলাম। জানকীবাবুর সঙ্গে পথে দেখা। তিনি বোধ হয় বেড়াতে বেরিয়েছেন। আমায় বললেন–আজই ফিরলেন?
তাঁর কথার উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ আমার মনে পড়ল, মিসমিদের কবচখানা আমার পকেটেই আছে এখনও–সামনে রাত আসচে আবার, ও-জিনিসটা সঙ্গে এনে ভালো করিনি, মামার বাড়ি রেখে আসাই উচিত ছিল বোধ হয়।
জানকীবাবুর পরামর্শটা একবার নিলে কেমন হয়, জিনিসটা দেখিয়ে?
কিন্তু ভাবলাম, এ-জিনিসটা ওঁর হাতে দিতে গেলে এখন বহু কৈফিয়ৎ দিতে হবে ওই সঙ্গে। হয়তো তিনি জিনিসটার গুরুত্ব বুঝবেন না–দরকার কী দেখানোর?