আমি বললাম–আপনি এখানে প্রায়ই যাতায়াত করেন? তাহলে তো হবেই আত্মীয়তা!
আমার স্ত্রী মারা গিয়েচে আজ বছর তিনেক। তারপর আমি প্রায়ই আসি না। তবে শাশুড়িঠাকরুন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন, আমায় আসার জন্যে চিঠি লেখেন, না এসে পারিনে।
ছেলেপুলে কী আপনার?
একটি ছেলে হয়েছিল, মারা গিয়েছে। এখন আর কিছুই নেই।
ও।
হঠাৎ জানকীবাবু আমার মুখের দিকে চেয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা, গাঙ্গুলিমশায়ের খুন সম্বন্ধে পুলিস কোনো সূত্র পেয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
কেন বলুন তো?
আমার বিশেষ কৌতূহল এ-সম্বন্ধে। গাঙ্গুলিমশায় আমার শ্বশুরের সমান ছিলেন। বড়ো স্নেহ করতেন আমায়। তাঁর খুনের ব্যাপারে একটা কিনারা না হওয়া পর্যন্ত আমার মনে শান্তি নেই। আমার মনে কোনো অহংকার নেই মশায়। আমি এ খুনের কিনারা করি, বা আপনি করুন, বা পুলিশই করুক, আমার পক্ষে সব সমান। যার দ্বারা হোক কাজ হলেই হল। নাম আমি চাইনে।
নাম কে চায় বলুন? আমিও নয়।
তবে আসুন-না আমরা মিলে-মিশে কাজ করি? পুলিশকেও বলুন।
পুলিশ তো খুব রাজি, তারা তো এতে খুব খুশি হবে।
বেশ, তবে কাল থেকে—
আমার কোনো আপত্তি নেই।
আচ্ছা, প্রথম কথা–আপনি কোনো কিছু সূত্র পেয়েছেন কিনা আমায় বলুন। আমি যা পেয়েছি আপনাকে বলি।
আমি এখানে এখন বলব না। পরে আপনাকে জানাব।
ননী ঘোষের ব্যাপারটা আপনি কী মনে করেন?
সেদিন তো আপনাকে বলেচি। ওকে আমার সন্দেহ হয়। আপনি ওকে সন্দেহ করেন?
নিশ্চয় করি।
আপনি ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পেয়েছেন?
সেই গহনা ব্যাপারটাই তো ওর বিরুদ্ধে একটা মস্ত বড়ো প্রমাণ।
তা আমারও মনে হয়েছে, কিন্তু ওর মধ্যে গোলমালও যথেষ্ট।
মহীন স্যাকরাকে নিয়ে তো? আমি মহীনকে সন্দেহ করিনে।
কেন বলুন তো?
মহীন তো খাতা লিখত না গাঙ্গুলিমশায়ের। ভেবে দেখুন কথাটা।
সে-সব আমিও ভেবেচি। তাতেও জিনিসটা পরিষ্কার হয় না।
চলুন না, দু-জনে একবার ননীর কাছে যাই।
তার কাছে আমি গিয়েছিলাম। তাতে কোনো ফল হবে না।
হিসেবের খাতাখানা কোথায়?
পুলিশের জিম্মায়।
আপনি ভালো করে দেখেচেন খাতাখানা?
দেখেচি বলেই তো ননীকে জড়াতে পারি নে ভালো করে।
কেন?
শুধু ননীর হাতের লেখা নয়, আরও অনেকের হাতের লেখা তাতে আছে।
কার কার?
জানকীবাবু ব্যথভাবে এ-প্রশ্নটা করে আমার মুখের দিকে যেন উৎকণ্ঠিত-আগ্রহে উত্তরের প্রতীক্ষায় চেয়ে রইলেন। আমি মৃত-মুসলমান ভদ্রলোকটির ও স্কুলের ছাত্রটির কথা তাঁকে বললাম। জানকীবাবু বললেন–ও, এই! সে তো আমি জানি–শ্রীগোপালের মুখে শুনেছি।
যা শুনেছেন, তার বেশি আমারও কিছু বলবার নেই।
পরদিন সকালে ননী ঘোষ এসে আমার কাছে হাজির হল। বললে–বাবু, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।
কী?
জানকীবাবু এ-গাঁয়ের জামাই বলে খাতির করি। কিন্তু উনি কাল রাতে আমায় যে-রকম গালমন্দ দিয়ে এসেছেন, তাতে আমি বড়ো দুঃখিত। বাবু, যদি দোষ করে থাকি, পুলিশে দিন–গালমন্দ কেন?
তুমি বড়ো চালাক লোক ননী। আমি সব বুঝি। পুলিশে দেবার হলে, তোমাকে একদিনও হাজতের বাইরে রাখব ভেবেচ।
বাবুও কি আমাকে এখনও সন্দেহ করেন?
লোকটা সাংঘাতিক ধূর্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ-খুন যেই করুক, ননী তার মধ্যে নিশ্চয়ই জড়িত। অথচ ও ভেবেচে যে, আমার চোখে ধুলো দেবে!
বললাম–সে-কথা এখন নয়। এক মাসের মধ্যেই জানতে পারবে।
বাবু, আপনি আমাকে যতই সন্দেহ করুন, ধর্ম যতদিন মাথার উপর আছে—
ধূর্ত লোকেরাই ধর্মের দোহাই পাড়ে বেশি! লোকটার উপর সন্দেহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
.
সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
সন্ধ্যার পরে আহারাদি সেরে অনেকক্ষণ বই পড়লাম! তারপর আলো নিবিয়ে দিয়ে নিদ্রা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেন জানি না–অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম হল না এবং বোধ হয়
সেইজন্যই সেই রাতে আমার প্রাণ বেঁচে গেল।
ব্যাপারটা কী হল খুলে বলি।
৩. এক কৃষ্ণপক্ষ
একাদশ পরিচ্ছেদ
সেও এক কৃষ্ণপক্ষের গভীর অন্ধকার রাত্রি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ছে আবার থেমে যাচ্চে, অথচ গুমট কাটেনি। আমার ঘরটার উত্তর দিকে একটা মাত্র কাঠের গরাদ দেওয়া জানলা, জানলার সামনাসামনি দরজা। পশ্চিম দিকের দেওয়ালে জানলা নেই–একটা ঘুলঘুলি আছে মাত্র।
রাত প্রায় একটা কী তার বেশি। আমার ঘুম আসেনি, তবে সামান্য একটু তন্দ্রার ভাব এসেচে।
হঠাৎ বাইরে ঘুলঘুলির ঠিক নীচেই যেন কার পায়ের শব্দ শোনা গেল! গোরু কী ছাগলের পায়ের শব্দ হওয়া বিচিত্র নয়–বিশেষ গ্রাহ্য করলাম না।
তারপর শব্দটা সেদিক থেকে আমার শিয়রের জানলার কাছে এসে থামল। তখনও আমি ভাবচি, ওটা গোরুর পায়ের শব্দ। এমন সময় আমার বিস্মিত-দৃষ্টির সামনে দিয়ে অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে কার একটা সুদীর্ঘ হাত একেবারে আমার বুকের কাছে–ঠিক বুকের ওপর এসে পৌঁছোলো–হাতে ধারালো একখানা সোজা-ছোরা, অন্ধকারেও যেন ঝকঝক করছে!
ততক্ষণে আমার বিস্ময়ের প্রথম মুহূর্ত কেটে গিয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি পাশমোড়া দিয়ে ছোরা-সমেত হাতখানা ধরতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য একটা বাঁশের লাঠিকে চেপে ধরলাম।
পরক্ষণেই কে এক জোর ঝটকায় লাঠিখানা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলে। সঙ্গেসঙ্গে ছোরার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগের আঘাতে আমার হাতের কবজি ও বুকের খানিকটা চিরে রক্তারক্তি হয়ে গেল।