কেন, শ্রীগোপালের মুখে সব শুনেছি।
আপনি তাকে সন্দেহ করেন?
খুব করি। তার সঙ্গে এখুনি দেখা করা দরকার। তার হাতেই যখন টাকার হিসেব লেখা হত…
দেখুন না, ভালোই তো।
হঠাৎ আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে জানকীবাবু বলেন–আচ্ছা, আপনি ঘটনাস্থলে ভালো করে খুঁজেছিলেন?
খুঁজেছিলাম বই কী।
কিছু পেয়েছিলেন?
আমি জানকীবাবুর এ-প্রশ্নে দস্তুরমতো বিস্মিত হলাম। যদি তিনি নিজেও একজন গোয়েন্দা হন, তবে তাঁর পক্ষে অন্য-একজন সমব্যবসায়ী লোককে একথা জিগ্যেস করা শোভনতা ও সৌজন্যের বিরুদ্ধে, বিশেষত যখন আগে-থেকেই এ ব্যাপারের অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত আছি।
আমি নিস্পৃহভাবে উত্তর দিলাম–না। এমন বিশেষ কিছু না।
জানকীবাবু পুনরায় জিগ্যেস করলেন–তাহলে কিছুই পাননি?
কিছুই না তেমন।
কাঠের পাতের কথাটা জানকীবাবুকে বলবার আমার ইচ্ছে হল না। জানকীবাবুকে বলে কী হবে? তিনি কি বুঝতে পারবেন জিনিসটা আসলে কী? মি. সোমের সাহায্য ব্যতীত কি আমারই বোঝার কোনো সাধ্য ছিল? মি. সোমের মতো পন্ডিত ও বিচক্ষণ গোয়েন্দা খুব বেশি নেই এদেশে, এ আমি হলপ করে বলতে পারি।
জানকীবাবু চলে গেল আমি শ্রীগোপালকে বললাম–তুমি একে কী বলেছিলে?
কী বলব!
ননী ঘোষের কথা বলেচ?
হ্যাঁ, তা বলেছি।
আমি ওকে তিরস্কারের সুরে বললাম–আমাকে তোমার বিশ্বাস না হতে পারে–তা বলে আমার আবিষ্কৃত ঘটনা-সূত্রগুলি তোমার অন্য ডিটেকটিভকে দেওয়ার কী অধিকার আছে?
শ্রীগোপাল চুপ করে রইল। ওর নির্বুদ্ধিতায় ও অবিবেচকতায় আমি যারপরনাই বিরক্তি বোধ করলাম।
.
নবম পরিচ্ছেদ
সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আনি মহীন স্যাকরার সঙ্গে আবার দেখা করতে গেলাম। মহীন আমায় দেখে ভয়ে-ভয়ে একটা টুল পেতে দিল বসবার জন্যে।
আমি বললাম–মহীন, একটা সত্যি কথা বলবে?
কী, বলুন!
তোমার সঙ্গে ননীর ঝগড়া-বিবাদ হয়েছিল কিছুকাল আগে?
মহীন আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললে–ননী বলেচে বুঝি? সব মিথ্যে কথা ওর বাবু, সব মিথ্যে।
আমি কড়াসুরে বললাম–ঝগড়া হয়েছিল তাহলে? সত্যি বলো!
মহীন চুপ করে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আস্তে-আস্তে বললে–হয়েছিল বাবু, কিন্তু আমার তাতে কোনো দোষ…
আমি সে-কথা বলিনি–ঝগড়া হয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করচি।
হ্যাঁ বাবু।
কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল, বলো এবার!
সোনার দর নিয়ে বাবু।
আচ্ছা, তুমি শ্রীগোপালের কাছে ননী ঘোষের তাবিজ গড়ানোর কথা এইজন্যে বলেছিল –কেমন, ঠিক কিনা?
হ্যাঁ বাবু।
তুমি তখন ভেবেছিল যে ননী ঘোষই খুন করেছে?
তা—না–
ঠিক বলো।
না বাবু।
তাহলে তুমিও যে দোষী হবে আইনত; তাই ভাবচ বুঝি?
মহীন স্যাকরা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, বললে–বাবু, তা–তা—
তোমাকে গ্রেপ্তারের জন্যে থানায় খবর দেব!
মহীন আমার পা জড়িয়ে ধরে বললে– দোহাই বাবু, আমার সব কথা শুনুন আগে। আপনি দেশের লোক–আমার সর্বনাশ করবেন না বাবু-কাচ্চা-বাচ্চা মারা যাবে।
কী, বলো!
তখন আমিও লুটের টাকা বলে সন্দেহ করিনি। কী করে করব! বলুন বাবু, তা কি সম্ভব?
তবে, কখন সন্দেহ করলে?
বাবু, শ্রীগোপালই আমায় বললে, আপনি ননী ঘোষকে সন্দেহ করেন। তখন আমি ভাবলাম, গহনার কথাটা প্রমাণ না করলে আমি মারা যাব এর পরে। তাই বলেছিলাম।
শ্রীগোপালের নির্বুদ্ধিতা দেখছি নানা দিক থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। যদি ওর বাবার খুনের আসামি ধরা না পড়ে, তবে সেটা ওর নির্বুদ্ধিতার জন্যেই ঘটবে।
.
দশম পরিচ্ছেদ
কথাটা শ্রীগোপালকে বলবার জন্যে তার বাড়ির দিকে চললাম।
রাস্তাটা বাড়ির পেছনের দিকে–শিগগির হবে বলে শট-কার্ট করে গেলাম বনের মধ্যে দিয়ে। সেই বন– যেখানে আমি সেদিন মিসমি-জাতির কবচ ও দাঁতনকাঠির গোড়া সংগ্রহ করেছিলাম।
অন্ধকারেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা সাদা-মতো কী কিছু দূরে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। জিনিসটা নড়চে-চড়চে আবার। অন্ধকারের জন্যে ভয় যেন বুকের রক্ত হিম করে দিলে।
এই বনের পরেই গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি–গাঙ্গুলিমশায়ের ভূত নাকি রে বাবা!
হঠাৎ একটা টর্চ জ্বলে উঠল–সঙ্গেসঙ্গে কে কড়া-গলায় হাঁকলে, কে ওখানে?
আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম– কে আপনি?
আমার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা মনুষ্যমূর্তি এবং টর্চের আলো-আঁধার কেটে গেলে দেখলাম, সে জানকীবাবু ডিটেকটিভ!
বিস্ময়ের সুরে বললাম–আপনি কী করছিলেন অন্ধকারে বনের মধ্যে?
জানকীবাবু অপ্রতিভ সুরে বললেন–আমি এই—এই—
ও, বুঝেচি। কিছু মনে করবেন না। হঠাৎ এসে পড়েছিলাম এখানে।
না না, কিছু না।
তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে চলি এগিয়ে। ভদ্রলোক শুধু অপ্রতিভ নয়, যেন হঠাৎ ভীত ও ত্ৰস্তও হয়ে পড়েছেন। কী মুশকিল! এসব পাড়াগাঁয়ে শহরের মতো বাথরুমের বন্দোবস্ত না থাকাতে সত্যিই অনেকের বড়োই অসুবিধে হয়।
জানকী বড়ুয়া প্রাইভেট-ডিটেকটিভকে এই অন্ধকারে গাঙ্গুলিমশায়ের ভূত বলে মনে হয়েছিল ভেবে আমার খুব হাসি পেল। ভদ্রলোককে কী বিপন্নই করে তুলেছিলাম!
সেদিন সন্ধ্যার পরে শ্রীগোপালের বাড়ি বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় জানকীবাবু আমার পাশে এসে বসলেন। তাঁকেও চা দেওয়া হল। জানকীবাবু দেখলাম বেশ মজলিশি লোক, চা খেতে খেতে তিনি নানা মজার মজার গল্প বলতে লাগলেন। আমায় বললেন–আমি তো মশায় গাঁয়ের জামাই, আজ চোদ্দো বছর বিয়ে করেচি, কাকে না চিনি বলুন গ্রামে, সকলেই আমার আত্মীয়।