মনুর দেখিলাম ভয় হইয়াছে। বলিল–নিবারণ!
কী?
তুমি হালে এসো—
এখন দাঁড় ছেড়ে দিলে ডিঙি বানচাল হয়ে যাবে।
তুমি এসো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে!
ঠিক থাকো। বাঁয়ে চাপো।
কতটা আছে?
কী জানি, ডাঙা দেখা যায় না। তুমি বসে থেকো না, দাঁড়িয়ে উঠে হাল ধরো। বসে হাল ধরলে জোর পাবে না।
আমার এসময় হঠাৎ একরকম মরিয়ার সাহস জোগাইল। যদি ওরা বিপন্ন হয়, তবে আমার কি উচিত নয় এদের সাহায্য করা?
বলিলাম–নিবারণ, ও নিবারণ!
সে বিরক্ত হইয়া বলিল–কী?
আমি তোমার হয়ে বাইব?
যেখানে বসে আছ বসে থাকো। মরবে?
তোমাদের সাহায্য করব।
আবার বকবক বকে? দেখছ না নৌকোর অবস্থা?
দেখেই তো বলছি।
কোনো কথা বলবে না।
এবার বিশালকায় পশোর উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে। এমন দৃশ্য কখনো দেখিনি। ডিঙির ডাইনে বাঁয়ে আর কিছু দেখা যায় না, শুধু পাহাড়ের মতো ঢেউ, জলের পাহাড়। সেই পাহাড়ের জলময় অধিত্যকায় আমাদের ডিঙিখানা মোচার খোলার মতো দুলিতেছে, নাচিতেছে, উঠিতেছে, পড়িতেছে, নাকানি-চুবানি খাইতেছে।
একবার বোঁ করিয়া ডিঙিখানা ঘুরিয়া গেল।
নিবারণ চিৎকার করিয়া উঠিল–সামাল! সামাল!
ডিঙি একধারে কাত হইয়া ছপাৎ করিয়া বড়ো এক ঝলক জল উঠিয়া পড়িল ডিঙির খোলে। নিবারণ আমাকে হাঁকিয়া বলিল–ডান দিকে চেপে–
কী করিতেছি না বুঝিয়া ডান দিকে চাপ দিতেই ডিঙি সেদিকে ভীষণ কাত হইয়া গেল। বোধ হয় ডিঙি উপুড় হইয়া পড়িত, নিবারণ দাঁড় দিয়া এক হ্যাঁচকা টান দিতে ডিঙি খানিকটা সোজা হইল।
নিবারণ বলিল–জল হেঁচতে হবে বাবু, পারবে?
বলিলাম–নিশ্চয়ই।
কিন্তু খুব সাবধানে। একটু টলে গেলেই নদীতে ডুবে মরবে।
ঠিক আছে।
সেঁউতি খুঁজে বার করো সাবধানে। খোলের মধ্যে আছে। মনু ভাই, সামলে–বাঁয়ে কসো। আমি সেঁউতি খুঁজিতে উপুড় হইয়া খোলের মধ্যে মুখ দিতে গিয়াছি, এমন সময় পিছন হইতে কে যেন আমায় এক প্রবল ধাক্কা দিয়া একেবারে খোলের মধ্যে আমাকে চাপিয়া ধরিল। আর একটু হইলে মাথাটা নৌকার নীচের বাড়ে লাগিয়া ভাঙিয়া যাইত। সঙ্গেসঙ্গে আমি ডিঙির উপরের পাটাতনের বাড় ডান হাতে সজোরে চাপিয়া না ধরিলে দ্বিতীয় ধাক্কার বেগ সামলাইতে-না-সামলাইতে তৃতীয় ধাক্কার প্রবল ঝাঁপটায় একেবারে জলসই হইতাম।
মনু আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল– গেল! গেল!
এইটুকু শুনিতে না শুনিতে আবার প্রবল এক ধাক্কায় আমাকে যেন আড়কোলা করিয়া তুলিয়া উপরের পাটাতনে চিত করিয়া শুয়াইয়া দিয়া গেল। কী করিয়া এমন সম্ভব হইল বুঝিলাম না। আমার তখন প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। চক্ষে অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে। শুধু নিবারণের কী একটা চিৎকার আমার কানে গেল অতি অল্পক্ষণের জন্যে।
তারপর বাঁ-হাতের উপরের দিকে একটা যন্ত্রণা অনুভব করিলাম। দম যেন বন্ধ হইয়া আসিতেছে। তখন দেখি নিবারণ ও মনু আমার পাশে আসিয়া হাজির হইয়াছে দাঁড় ও হাল ছাড়িয়া। এ উত্তাল নদীগর্ভে এ কাজ যে কতদূর বিপজ্জনক, এটুকু বুঝিবার শক্তি তখনও আমার ছিল। আমি বলিলাম–ঠিক আছি, তোমরা যাও, ডিঙি সামলাও–
ভগবানের আশীর্বাদে আমার বিপদ সে-যাত্ৰা কাটিয়া গেল। একটু পরে আমি উঠিয়া বসিলাম। তখনও আমাদের ডিঙি অকূল জলে, সেইরকম পর্বতপ্রমাণ ঢেউ চারদিকে, জল ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। নিবারণ আমাকে হাঁক দিয়া আবার বলিল– সেঁউতি খোঁজো–ডিঙি যাবে এবার–ডুবু-ডুবু হয়ে আসছে।
সেবার সেঁউতি খুঁজতে গিয়াই বিপন্ন হইয়াছিলাম। এবার অতি কষ্টে আধখোল ভরতি জলের মধ্যে হাতড়াইয়া সেঁউতি বাহির করিয়া দুই হাতে প্রাণপণে জল হেঁচিতে লাগিলাম। দেহে যেন মত্ত হস্তীর বল আসিল। আমার অক্ষমতার জন্যে আমার দুই বালক-বন্ধু জলে ডুবিয়া মারা যাইবে? তাহা কখনো হইতে দিব না। ভগবান আমার সহায় হউন। অনেকখানি জল হেঁচিয়া ফেলিলাম। সেই অবস্থাতেও আমার ঘাম বাহির হইতেছিল। ভগবান আমার প্রার্থনা শুনিলেন। ডিঙি অনেকটা হালকা হইয়া গেল। মনু বা নিবারণ কেহ কথা বলে নাই। এবার নিবারণ বলিয়া উঠিল–সাবাস!
কী?
ডিঙি হালকা লাগছে।
কেন, বলছিলে যে আমার কিছু করবার নেই?
বেশ করেছ।
ডিঙি ভেড়াতে পারবে ডাঙায়?
আলবৎ। স্থির জলে এসে পড়েছি, আর ভয় নেই। নদীর সব জায়গায় সমান স্রোত কাটিয়ে এসেছি।
আরও এক ঘণ্টা পরে আমাদের পাড়ে ডিঙি আনিয়া লাগাইয়া দিল নিবারণ।
একদিন রাত্রে মনু আমায় চুপি চুপি বলিল–এক জায়গায় যাবে? কাউকে না বলে বেরিয়ে চলো–
দ্বিতীয়বার অনুরোধের অপেক্ষা না করিয়া উহার সঙ্গে বাড়ির বাহির হইলাম। দেখিলাম, একটু দূরে নিবারণ দাঁড়াইয়া। যেখানে নিবারণ সেইখানে মস্ত বড়ো কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে
নিবারণ বলিল–বাবু, চলো রাত্রে একটা কাজ করে আসি–
কী কাজ এত রাত্রে?
বাঘ মারব।
বাঘ কী করে মারবে? বন্দুক কই?
দেখবে চলো।
তিনজনে গিয়া খালের নীচে ডিঙিতে চড়িলাম। ছোটো খাল, দুই ধারে গোলপাতার জঙ্গল নত হইয়া জল স্পর্শ করিয়াছে। জোনাকি-জ্বলা অন্ধকার রাত্রে এই নিবিড় বনভূমির শোভা এমনভাবে কখনো দেখি নাই। মনু ও নিবারণকে মনে মনে অনেক ভালোবাসা জানাইলাম আমাকে এভাবে জঙ্গলের রূপ দেখাইবার জন্য।
এক জায়গায় ডিঙি বাঁধা হইল কেওড়া গাছের গুঁড়িতে।
আমি বলিলাম–অন্ধকারে নামব?
নিবারণ গিয়া খোলের ভিতর হইতে দুইটা মশাল বাহির করিল। মনু ও আমি দুইটা মশাল হাতে আগে আগে চলি, ও আমাদের পিছনে পিছনে আসে। কিছু দূরে জঙ্গলের মধ্যে গিয়া নিবারণ হঠাৎ দাঁড়াইয়া গেল! আনন্দের সুরে বলিয়া উঠিল– বোধ হয় হয়েছে।