আমি বিস্ময়ের সুরে বলিলাম–সত্যি?
নিবারণ বলিল–দেখো। ও আমার কতবার পরখ করা। এসব বনে নানা অদ্ভুত জিনিস আছে। একরকম গুবরে পোকা আছে, তাদের গা অন্ধকারে জ্বলে। হাঙুরে শিঙি মাছ আছে, কাঁটা হেনে তোমার সমস্ত শরীর অবশ করে দেবে।
নিবারণের কথাই ঠিক। আমরা খালের পাড় পর্যন্ত খোঁজ করিয়াও হরিণের দলের কোনো সন্ধানই পাইলাম না। এক জায়গায় কাদার উপর মোটা কাঠের গুঁড়ি টানিয়া লইয়া যাইবার দাগ দেখিতে পাইয়া নিবারণ মনু একসঙ্গেই ভয়ের সুরে বলিয়া উঠিল–ওরে বাবা!–এ কী?
চাহিয়া দেখিয়া কিছু বুঝিতে না পরিয়া বলিলাম–কী এটা?
নিবারণ বলিল–বড়ো অজগর সাপ এখান দিয়ে চলে গিয়েছে, এটা তারই দাগ। একটু সাবধানে থাকবে সবাই–অজগর বড়ো ভয়ানক জিনিস। একবার ধরলে ওর হাত থেকে আর নিস্তার নেই। বলিতে বলিতে একটা কেওড়া গাছের দিকে উত্তেজিতভাবে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিতে লাগিল–ওই দেখোচট করে এসো–
দেখি, এক বিরাটকায় সর্প কেওড়া গাছের ডালে ল্যাজ জড়াইয়া নিশ্চলভাবে খালের জলের হাতচারেক উপরে ঝুলিয়া আছে। সর্পের গায়ের রং গাছের ডালের রঙের সঙ্গে মিশিয়া এমন হইয়া গিয়াছে যে সর্পদেহকে মোটা ডাল বলিয়া ভ্রম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। নিশ্চল হইয়া থাকার দরুন এ ভ্রম না হইয়া উপায় নাই।
আমি কী বলিতে যাইতেছিলাম, নিবারণ বলিল–আস্তে, একদম চুপ–
কী?
দেখো না—চুপ–
আমরা গাছের গুঁড়ির আড়ালে নিস্পন্দ অবস্থায় দাঁড়াইয়া। নিবারণ আমাদের আগের দিকে। কী হয় কী হয় অবস্থা! মনু হয়তো কিছু বোঝে, আমি নতুন লোক কিছুই বুঝি না ব্যাপার কী। ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাটিল। আমি বিরক্ত হইয়া উঠিলাম। কতক্ষণ এভাবে থাকা যায়। কেনই-বা এখানে খাড়া হইয়া আছি কাঠের পুতুলের মতো? সর্পদেহও আমাদের মতো নিশ্চল। গাছের ডাল নড়ে তো সাপ নড়ে না। এমন সময়ে এক আশ্চর্য কান্ড ঘটিল। আজও সে-ছবি আমার চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে।
একটা বড়ো শিঙেল হরিণ বেতঝোঁপের পিছন থেকে সন্তর্পণে খালের দিকে আসিতে লাগিল। বেতঝোঁপের ডান দিকে একটা ছোটো হেঁতাল গাছ; তারপরই বড়ো গাছটা, যাহার ডালে সর্প ঝুলিতেছে। হরিণটা একবার আসে, শুকনো পাতার মচমচ শব্দ হয়, আবার খানিকটা দাঁড়ায়, আবার কী শোনে, আর একটু আসে, সর্পের ধ্যানমগ্ন অবস্থা– সে কি হরিণটা দেখিতে পায় নাই? নড়ে না তো? হরিণটা এইবার আসিয়া খালের কাদা পার হইয়া জলে নামিয়া চকিতে একবার এদিক-ওদিক চাহিয়া জলে মুখ দিল। জল খানিকটা পানও করিল। যেখানে হরিণ জলপানরত, সর্পের দূরত্ব সেস্থান হইতে দু-হাতের বেশি। হঠাৎ সর্পের ধ্যান ভাঙিয়া গেল। বিদ্যুতের চেয়েও বেশি বেগে সেই বিশালদেহ অজগর দেহ লম্বা করিয়া দিয়া হরিণের ঘাড় কামড়াইয়া ধরিতেই হরিণ আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল। তারপর সব চুপ। সাপটা ডাল হইতে নিজের দেহ ছাড়াইয়া ক্রমে ক্রমে হরিণের সমস্ত দেহ জড়াইয়া প্যাঁচের উপর প্যাঁচ দিতে লাগিল। খানিকটা পরে হরিণের শিং আর পা দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাইতেছিল না। গলাটা বোধ হয় প্রথমেই চাপিয়াছিল।
মনু ইশারা করিয়া জানাইল সে তির ছুড়িবে কিনা।
নিবারণ ইঙ্গিতে বারণ করিল।
সাপ তখন হরিণের দেহটাকে পায়ের দিক হইতে গিলিতে শুরু করিয়াছে। অজস্র লালারস সর্পের মুখবিবর হইতে নিঃসৃত হইয়া হরিণের সর্বদেহ সিক্ত হইতেছে, স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। যখন পা দু-খানা সম্পূর্ণ গেলা হইয়া গিয়াছে, তখন নিবারণ প্রথম কথা কহিয়া বলিল–ব্যাস! এইবার সবাই কথা বলো–
আমি বলিলাম–বলব?
কোনো ভয় নেই, বলো।
চোখের সামনে এই ভীষণ দৃশ্য ঘটিতেছে, বিস্ময়ে ও ভয়ে কেমন হইয়া গিয়াছি দু জনেই। অত সাহসী মগ বালক মনুর মুখ শুকাইয়া গিয়াছে, চোখে অদ্ভুত বিস্ময়ের দৃষ্টি। সে প্রথম কথা বলিল–পালাই চলো।
নিবারণ বলিল–পালানোর দরকার ছিল বরং আগে। এখন আর কী।
আমি বলিলাম– কেন?
ও সাপ যদি আগে আমাদের টের পেত তবে ডালের প্যাঁচ খুলে আমাদের আক্রমণ করবার চেষ্টা করত–এখন ওর নড়নচড়ন বন্ধ, শিকার গিলছে যে।
তাহলে আমরা ওকে শেষ করে দিই?
মনু ও নিবারণ দুইজনে হাসিয়া উঠিল। নিবারণ বলিল–অত সোজা নয়।
বলিলাম– কেন, তির ছুঁড়ে?
ছুঁড়ে দেখতে পার। কিছুই হবে না। দু-একটা তিরের কর্ম নয় অজগর শিকার।
তবে?
ওর অন্য উপায় আছে। এখন শুধু দেখে যাও।
দেখব আর কী সে বীভৎস দৃশ্য! অত বড়ো শিঙেল হরিণের প্রায় সমস্তটা অজগর গিলিয়া ফেলিয়াছে, কেবল মুখ আর শিং দুইটা বাদে। কিছুক্ষণ পরে মনে হইল একটা বিশালকায় শিংওয়ালা অজগর জলের ধারে হেঁতাল গাছের নীচে শুইয়া আছে। চার ঘণ্টা লাগিল সমস্ত ব্যাপারটা ঘটিতে। আমরা আসিয়া আমাদের ডিঙিতে চড়িলাম। বেলা বেশি নাই। নিবারণ ডিঙি ছাড়িল। পরে নদীতে জোয়ার আসিতেছে। একটু একটু বাতাস উঠিতেছে দেখিয়া মনু বলিল–সাবধান–সাবধান–
নিবারণ বলিল– জোর করে হাল ধরো।
আমি বলিলাম– কেন, কী হয়েছে?
কিছু না। সাবধান থেকো।
কীসের ভয়?
পরে সেকথা হবে।
বেশি দূর যাইতে-না-যাইতেই নিবারণের কথার অর্থ বুঝিতে পারিলাম। জোয়ার বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে মাঝনদীতে জোরে হাওয়া উঠিল। এক-একটা ঢেউয়ের আকার দেখিয়া আমার মুখ শুকাইয়া গেল, বুকের মধ্যে কেমন করিতে লাগিল। সে কী ঢেউ! ঢেউ যে অত বড়ো হয়, তাহা কী করিয়া জানিব? সমুদ্রে বড়ো ঢেউ হয় শুনিয়াছি কিন্তু এ তো নদী, এখানে এমন ঢেউ? আমাদের ডিঙি দুই পাশের পর্বত-প্রমাণ ঢেউয়ের খোলের মধ্যে একবার একবার পড়িতে লাগিল, আবার খানিকক্ষণ বেশ যায়, আবার ঢেউয়ের পাহাড় উত্তাল হইয়া উঠে।