মনুদের বাড়ির নীচে ছোট্ট একটা খাল। এই খালের ধারে ছিল একটা ডিঙি বাঁধা। দু-জনে ডিঙিতে গিয়া তো উঠিলাম। খানিক পরে আর একজন ছেলে আসিয়া আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, উহার নাম নিবারণ মাঝি। মনুদের নৌকা চালায় যে মাঝি তাহারই ছেলে। সে খুব ভালো নৌকা চালায় বলিয়াই তাহাকে লওয়া হইল।
একটা জিনিস দেখিলাম। নিবারণ একটা থলিতে অনেক চিড়ামুড়ি আনিয়াছে। এত চিড়ামুড়ি আনার কারণ কী তখন বোঝা যায় নাই বটে, কিন্তু বেশি দেরিও হয় নাই বুঝিতে।
খালের পাশে কেওড়া ও গোলপাতা বনের গায়ে ছলাৎ ছলাৎ করিয়া জোয়ারের জল লাগিতেছে। রোদ পড়িয়া চকচক করিতেছে নদীজল। ঘন নিবিড় অরণ্যের বন্যবৃক্ষের গুঁড়িতে গুঁড়িতে জলের কম্পমান স্রোতধারার ছায়া।
আমার মনে চমৎকার একটা আনন্দ। মুক্তির একটা আনন্দ–যাহার ঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারিব না। দাদামশায়ের সঙ্গে সুন্দরবনে না আসিলে এ আনন্দ পাইতাম কি? ছিলাম ক্ষুদ্র গৃহকোণে আবদ্ধ তেরো বছরের বালক। বিশাল পৃথিবীর বুকে যে কত আনন্দ, কী যে তাহার মুক্তিরূপা মহিমা, আমার কাছে ছিল অজানা। নিবারণ অনেক দূরে লইয়া আসিয়াছে, বনের প্রকৃতি এখানে একটু অন্যরকম। বনের দিকে চাহিয়া দেখি একটা গাছে অনেক বাতাবি লেবু ফলিয়া আছে–ডাঙার খুব কাছে।
বলিলাম–নিবারণ, নিবারণ, থামাও না ভাই। ওই দেখো—
নিবারণ ডিঙি ভালো করিয়া না থামাইয়াই ডাঙার দিকে চাহিয়া বলিল–কী?
ওই দেখো। পাকা বাতাবি লেবু!
না বাবু।
ওই যে, দেখো না! মনু, চেয়ে দেখো ভাই—
নিবারণ হাসিয়া বলিল–একটা খেয়ে দেখবে বাবু?
কেন?
ওকে বলে পশুর ফল। পাখিতে খায়। মানুষের খাবার লোভে গাছে থাকত?
মনুও হাসিয়া নিবারণের কথায় সায় দিল।
খালের মুখ গিয়া একটা বড়ো নদীতে পড়িল–তাহার অপর পাড় দেখা যায় না। এইবার আমাদের ডিঙি সামনের এই বড়ো নদীতে পড়িবে। নদীর চেহারা দেখিয়া আমার বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল। এত ঢেউ কেন এ নদীতে?
বলিলাম–এ কী নদী ভাই?
নিবারণ এ অঞ্চলের অনেক খবর রাখে। সে বলিল–পশোর নদী। খুলনা জেলার বিখ্যাত নদী। হাঙর-কুমিরে ভরা। শিবসা আর পশোর যেখানে মিশেছে, সে-জায়গা দেখলে তো তোমার দাঁত লেগে যাবে ভাই।
খুব বড়ো?
সাগরের মতো। চলো সেখানে একটা জিনিস আছে, একদিন নিয়ে যাব।
কী জিনিস?
এখন বলব না। আগে সেখানে নিয়ে যাব একদিন। এইবার পশশার নদীতে আমাদের ডিঙি পড়িয়া কূল হইতে ক্রমশ দূরে চলিল। খানিকটা গিয়া হঠাৎ নিবারণ দাঁড় ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া বহুদূর ওপারের দিকে চাহিয়া বলিল–কী ওটা?
মনু বলিল–কই কী?
ওই দেখো। একটু একটু দেখা যাচ্ছে।
ভালো দেখা গেল না কি?
কী জিনিস ওটা?
আমিও ততক্ষণে ডিঙির ওপর দাঁড়াইয়া উঠিয়াছি। ভালো করিয়া চাহিলাম বটে, কিন্তু কিছু দেখা গেল না। নিবারণ নদীতে পাড়ি দিতে দিতে প্রায় মাঝখানে আসিল। এবার বেশ দেখা যাইতেছিল ব্যাপারটা কী। এক পাল হরিণ কেওড়াবনে জলের ধারে চরিতেছে। একটা হরিণ কেওড়া গাছের গুঁড়ির গায়ে সামনের দুই পা দিয়া উঁচু হইয়া গাছের ডালের কচিপাতা চর্বণ করিতেছে। কী সুন্দর ছবিটা! নিবারণ মনুকে বলিল–ভাই, আজ যাত্রা ভালো। ওই হরিণের পালের মধ্যে একটা মারা পড়বে না? এক-একটাতে এক মণ মাংস। দু-মণ মাংসওয়ালা হরিণও ওর মধ্যে আছে।
মনু বলিল–চলো।
নিবারণ বলিল–শক্ত করে হাল ধরতে যদি না সাহস করো, তবে তুমি দাঁড় নাও। এর নাম পশশার নদী। খুব সাবধান এখানে।
আমি সভয়ে বলিলাম– দে মনু, ওর হাতে হাল।
মনু নির্ভয় কণ্ঠে বলিল–মগের ছেলে অত ভয় করে না। হাল ধরতে পারব না তো কী? খুব পারব। টানো দাঁড়।
অত বড়ো নদীতে পাড়ি দিতে অনেকক্ষণ লাগিল। আমরা যেখানে নামিলাম, সে জায়গাটা একবারে জনহীন অরণ্য, একটু দূরে একটা ছোটো খাল জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছে, তীরে গোলপাতা ও বেতের ঝোঁপ।
কোথায় হরিণ। সব সরিয়া পড়িয়াছে।
মনু ছাড়িবার পাত্র নয়। সে নৌকা থামাইয়া আমাদের সঙ্গে করিয়া ডাঙায় নামিল। বলিল –চলো, জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে দেখি–
নিবারণ হরিণের পায়ের দাগ অনুসরণ করিয়া অনেকদূর লইয়া চলিল আমাদের। এক জায়গায় কী একটা সরু দুচোলো জিনিস আমার পায়ে ঢুকিয়া যাইতেই আমি বসিয়া পড়িলাম। ভয় হইল সাপে কামড়ায় নাই তো?
নিবারণ ছুটিয়া আসিয়া আমাকে তুলিয়া দাঁড় করাইল। বলিল– এঃ রক্ত পড়ছে যে? শুলো ফুটেছে দেখছি–সাবধানে যেতে হয় জঙ্গলের মধ্যে
শূলো কী?
গাছের শেকড় উঁচু হয়ে থাকে কাদার ওপরে। তাকে শূলো বলে।
মনু বলিল–আমার বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। শুলোর জন্যে একটু সাবধানে হেঁটো জঙ্গলে।
জঙ্গলের শোভা সে-স্থানটিকে মনোহর করিয়াছে। কেওড়া ও গরান গাছের মাথায় একরকম কী লতার বেগুনি ফুল। বড়ো গাছে এক প্রকারের সাদা ফুল জোয়ারের জলে নামিয়া শূলোর দল কাদার উপর মাথা তুলিয়া সারবন্দি বর্শার ফলার মতো খাড়া হইয়া আছে। কুস্বরে কী একটা পাখি ডাকিতেছে গাছের মগডালে।
নিবারণ থমকাইয়া দাঁড়াইয়া বলিল–দাঁড়াও না? মাছজটা ডাকছে, নিকটে বাঘ আছে। কোথাও, ওরা হরিণদের জানিয়ে দেয় ডাক দিয়ে। ভারি চালাক পাখি।
মনু বলিল–বাঘ নয়। মানুষ-বাঘা, মানে আমরা।
–তাও হতে পারে। এ ত্রিসীমানায় হরিণ থাকবে না আর।