বাড়ি ফিরিয়া গেলে মনুর বাবা জিজ্ঞাসা করিল, কী, আজ কী শিকার করলে? আমরা সকল ঘটনা তাহাকে বলিলাম এবং এমন শিকারটা পাখিগুলোর জ্বালায় হাতছাড়া হইল বলিয়া দুঃখপ্রকাশ করিলাম। মনুর বাবা সেই কথা শুনিয়া, আমার প্রায়ই হয়। কেবল গন্ডার কেন, পাখির জ্বালায় অনেক শিকারই ওইরকম করে হাতছাড়া হয়। গন্ডারের গায়ে একরকম খুব ছোটো ছোটো কীট আছে তারা গন্ডারকে বড়ো যাতনা দেয়। পাখিরা সেই কীট ঠোঁট দিয়ে খুঁটেখুটে খায়, এতে গন্ডারেরও উপকার হয়, তাদেরও পেট ভরে। শুধু শরীরের নয়, নাকের মধ্যে, চোখের কোণে, কানের বা মুখের ভেতর থেকেও এরা ওই কীট খুঁটে খুঁটে বার করে। চোখ বা কান প্রভৃতি নরম জায়গা থেকে কীট বার করবার সময় গন্ডারদের সময় সময় বেশ একটু যাতনা পেতে হয়। কিন্তু কীটের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারা সে কষ্ট সহ্য করে থাকে। এই পাখিরা যে কেবল কীটের হাত থেকেই গন্ডারকে রক্ষা করে তা নয়, মানুষের হাত থেকেও এদের রক্ষা করে। যখনই গন্ডারের কোনো বিপদ দেখে, তখনই এরা খুব চিৎকার আরম্ভ করে এবং তাতেই গন্ডারের হুশ হয়–গন্ডার তখন বিপদ বুঝতে পেরে পালায়।
গোরু-মহিষ প্রভৃতির গায়ে ও মাথায় বসে একরকম পাখিকে তোমরা ঠোকরাতে দেখে থাকবে। তাদেরও ওই কাজ। গোরু বা মহিষের গায়েও একরকম কীট আছে, তারা এদের বড়ো কষ্ট দেয়, পাখিরা ওই সকল কীট ঠুকরে খায় এবং কোনো বিপদের আশঙ্কা দেখলে তারা ওইরকম করে গোরু, মহিষ প্রভৃতিকে সতর্ক করে দেয়।
এ তো গেল গোরু, মহিষ, গন্ডার প্রভৃতির কথা। পাখিদের ঠোকরানিতে ওরা ব্যথা পেলেও তাদের কিছু বলে না। আর কিছু করবার ক্ষমতাও তাদের বড়ো একটা নেই। পিঠের ওপর বেশ ঠোকরাচ্ছে, ব্যথা পেলে বড়ো জোর একবার শিং নাড়া দেবে, আর তখনি পাখিরা উড়ে সরে যায়, শিং নাড়াই সার। যেখানে বিপদের বিলক্ষণ আশঙ্কা আছে, সেখানেও পাখিদের খুব যেতে দেখা যায়। একবার আমি দেখলাম জলার ধারে একটা প্রকান্ড কুমির চোখ বুজে হাঁ করে বেশ স্থিরভাবে পড়ে আছে। আমি মনে করলাম, বেশ সুবিধাই হয়েছে– হাঁ করে আছে, ঠিক মুখের ভেতর গুলিটি চালিয়ে দিলেই কাজ হবে। এই ভেবে যেমন বন্দুক তুলেছি অমনি কতকগুলি পাখি ভারি ডাকাডাকি আরম্ভ করল। কুমিরটা সেই ডাকে চোখ খুলেই মুহূর্তের মধ্যে জলে লাফিয়ে পড়লে। আমার আর গুলি করা হল না। কুমিরের দাঁতের ভেতর একরকম কীট জন্মায়, সেই কীটের জ্বালায় দাঁতের গোড়া ফুলে কুমিরকে এক সময় ভারি কষ্ট পেতে হয়। তাই প্রায়ই সন্ধ্যার আগে দেখতে পাওয়া যায় যে, জলের ধারে কুমির হাঁ করে পড়ে আছে আর এক জাতীয় পাখি নিঃসংকোচে নির্ভয়ে তার সেই মুখের ভেতর গিয়ে দাঁতের ভেতর থেকে পোকাগুলো খুঁটেখুঁটে বার করছে। এমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। কুমির, হাঁ করেই আছে, পাখিরাও ঘুরে-ফিরে পোকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কুমির বিলক্ষণ হিংস্র জন্তু, যখন হাঁ করে থাকে, তখন এক-একবারে চার-পাঁচটারও বেশি পাখি তাদের মুখের মধ্যে যায়। ইচ্ছা করলে একবার মুখ বন্ধ করলেই পাখিগুলি উদরসাৎ হয়। কিন্তু যারা তাদের এত উপকার করে দাঁতের পোকা ভালো করে, তাদের সঙ্গে তারা এমন অধর্ম করে না। তবে কখনো কখনো এমন হয় যে, খুব বেশিক্ষণ হাঁ করে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে হয়তো হঠাৎ মুখ বন্ধ করে বসে। তখন যদি কোনো পাখি বেরোতে না পেরে মুখের ভেতর থেকে যায়, তবে সে এমন জোরে ঠোঁট দিয়ে মুখের ভেতরে আঘাত করতে থাকে যে, কুমিরকে বাপের সুপুত্তুর হয়ে তখনই আবার হাঁ করতে হয়।
সে যাহা হউক, কথায় কথায় আমরা আসল কথাই ভুলিয়া গিয়াছি, বাঘটা তো এ পর্যন্ত কোনো মতেই মারা পড়িল না। কিন্তু একদিন ভারি মজা হইল। সকাল বেলা বাঘের ভয়ানক ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙিয়া গেল, আমি তো চমকিয়া উঠিলাম। উঠিয়া শুনিলাম, মনুর বাবা বলিতেছে, আপদ চুকেছে, বাঘ ফাঁদে পড়েছে। তখন আর বিলম্ব না করিয়া তিরধনুক, বন্দুক ও লাঠি প্রভৃতি লইয়া সকলেই বাহির হইয়া পড়িল। আমরাও সঙ্গে গেলাম। বাঘটাকে মারিবার জন্য যেমন সকলে বন্দুক ও তিরধনুক লইয়া বেড়াইত, তেমনি এক জায়গায় জাল দিয়া একটা ফাঁদও পাতিয়া রাখা হইয়াছিল। অনেক সময় এই সকল ফাঁদে বাঘ ধরা পড়ে।
আমরা গিয়া দেখিলাম, আমাদের সেই জালে বাঘটা ধরা পড়িয়া ভয়ানক তর্জন-গর্জন করিতেছে এবং জাল ছিঁড়িয়া বাহির হইবার জন্য ভারি লম্ফঝম্ফ করিতেছে। কিন্তু বড়ো বেশিক্ষণ লম্ফঝম্প করিতে হইল না। জালের মধ্যে অধিকক্ষণ রাখাটা নিরাপদ নয় বলিয়া তখনই গুলি করিয়া তাহাকে মারিয়া ফেলা হইল।
কিছুকাল পরে মনু একদিন আমায় চুপি চুপি বলিল– চলো, আজ শিকারে যাওয়া যাক–
বলিলাম– কোথায়?
সে বলিল– সেখের ট্যাঁকে।
সে আবার কোথায়?
চলো দেখাব।
একদিন দুপুরের আগে আহারাদি সারিয়া দু-জনেই রওনা হইলাম। উহাদের বাড়িতে ভাত খাইতে আমার প্রথম প্রথম বড়োই অসুবিধা হইত। মনুকে বলি–কী রে এটা?
ও বলে–শুঁটকি মাছ।
পারব না খেতে। কখনো না।
কেন?
অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে যে রে!
দু-পাঁচ দিন খেতে খেতে ভালো লাগবে দেখো।
হ্যাঁ, তা আবার কখনো লাগে?
আচ্ছা দেখে নিও।
সেই থেকে মাস দুই কাটে। শুঁটকি মাছে আর দুর্গন্ধ পাই না। মন্দ লাগে না ও জিনিসটা আজকাল। মনুর কথাই ঠিক।