মনু আমার সমবয়স্ক হইলেও তাহার শরীর খুব বলিষ্ঠ ছিল। এত অল্প বয়সে এ প্রকার সাহসী বালক আমি এ পর্যন্ত দেখি নাই। তির চালনা, তলোয়ার খেলা এবং বন্দুকের ব্যবহার সে এই বয়সেই সুন্দর শিখিয়াছে। তাহার সঙ্গে থাকিয়া আমারও সে-সকল কিছু অভ্যাস হইয়াছিল।
সুন্দরবনে অনেক মধুর চাক জন্মে। সেই সকল চাক ভাঙিয়া মধু সংগ্রহ করা কতকগুলি লোকের ব্যবসায় আছে। আমাদেরও একদিন সখ হইল, একটি চাক ভাঙিব। খুঁজিয়া খুঁজিয়া একটি চাকও পাইলাম। কিন্তু কাছে গিয়া দেখি, তাহাতে এত মৌমাছি বসিয়া আছে যে, একবার যদি তাহারা টের পায়, তাহা হইলে আমাদের চাক ভাঙার শখ মিটাইবে। সুতরাং আমাদের চাক ভাঙা হইল না। আমরা দুঃখিত মনে বাড়ি ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় একটা হরিণ দেখিতে পাইলাম। আমরা যখনই বাড়ির বাহির হইতাম, তখনই তিরধনুক ও বন্দুক লইয়া বাহির হইতাম, কেননা কখন কোন বিপদে পড়ি তাহার ঠিকানা নাই। হরিণটা দেখিয়া মনু বলিল, বেশ হয়েছে, শুধু-হাতে আর বাড়ি ফিরতে হল না। কিন্তু এখান থেকে হরিণটাকে মারবার সুবিধা হবে না, মাঝখানে ওই একটা ঝোঁপ রয়েছে। খুব পা টিপে টিপে আমার পেছনে পেছনে এসো, একটু ঘুরে গেলে বেশ সুবিধা পাওয়া যাবে? মনুর কথামতো আমি তাহার পিছনে চলিলাম। কিন্তু একটু যাইয়াই মনু থমকিয়া দাঁড়াইল। আমি হরিণটার দিকে চাহিতে চাহিতে চলিতেছিলাম, একেবারে মনুর গায়ের উপর গিয়া পড়িলাম।
সে আমার গা টিপিয়া কানে কানে বলিল, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। এক চুলও নড়ো না কথাও কয়ো না, ওই দেখো। মনু হাত বাড়াইয়া সম্মুখের দিকে দেখাইয়া দিল। চাহিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার সমস্ত শরীর থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। দেখিলাম, আমাদের সম্মুখে ৮/১০ হাত দূরে একটা মাটির ঢিবির কোলে একটা বাঘ ওই হরিণটাকে লক্ষ করিয়া আড়ি পাতিয়াছে। আমার বাকরোধ হইয়া গিয়াছিল, নতুবা হয়তো চিৎকার করিয়াই উঠিতাম। তাহা হইলে আমাদের যে দশা হইত তাহা তো বুঝিতেই পারিতেছ। মনুর দেখিলাম অসীম সাহস, সে এক হাতে আমাকে এবং আর এক হাতে বন্দুকটি লইয়া স্থির হইয়া একদৃষ্টে বাঘের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। বোধ হইল, তাহার নিঃশ্বাসও পড়িতেছে না। বাঘটা প্রকান্ড, অত বড়ো একটা জানোয়ার চলিতেছে, অথচ একটুও শব্দ হইতেছে না। এও বড়ো আশ্চর্য বোধ হইল। পরে জানিতে পারিলাম যে কীজন্য ইহারা এত নিঃশব্দে চলিতে পারে। বিড়ালের পায়ের পাতার গঠন তোমরা দেখিয়া থাকিবে, ইহাদের পাও ঠিক সেইরকম, ইহাদের আঙুলের মাথায় খুব তীক্ষ্ণ নখ আছে, আবশ্যক মতো এই নখ বাহির হয় এবং অন্য সময়ে ইহা কচ্ছপের শুড়ের ন্যায় ভিতরে ঢুকিয়া থাকে, তখন পায়ের পাতাটি বেশ গদির মতো হয়। সুতরাং হাঁটিবার সময় কিছুমাত্র শব্দ হয় না। সে যাহাই হউক, বাঘ আড়ি পাতিয়া এক লাফে গিয়া হরিণটার উপর পড়িল এবং তাহার সম্মুখের পায়ের এক আঘাতেই হরিণটার ঘাড় ভাঙিয়া ফেলিল, তারপর তাহাকে লইয়া জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিল। আমরাও প্রাণ লইয়া সে যাত্রায় বাড়ি ফিরিলাম।
আর একদিন একটা বাঘ ভারি জব্দ হইয়াছিল। তাহার যে-দুর্দশা হইয়াছিল, বলি শুনো। বাঘ সুন্দরবনের বলিলেই হয়, কিন্তু সুন্দরবনের মহিষগুলিও বড়ো ভয়ংকর, অত বড়ো ও বলবান মহিষ অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। বাঘে-মহিষে সুন্দরবনে প্রায়ই লড়াই হয়। কখনো বাঘের জিত হয়, কখনো-বা মহিষকে জিতিতে দেখা গিয়া থাকে। সে যাহাই হউক, একদিন একটা মহিষের বাচ্চা চরিতে চরিতে বাথান হইতে একটু দূরে গিয়া পড়িয়াছিল। একটা বাঘ বেচারাকে দেখিয়া লোভ সামলাতে না পারিয়া, যেমন তাহাকে ধরিবার জন্য লাফ দিতে যাইবে, এমন সময় বাচ্চাটি তাহা দেখিতে পাইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। সেই শব্দে একেবারে ছয়-সাতটা মহিষ সেইদিকে দৌড়িয়া আসিল। বাঘ তখন আর পালাইবার অবসরটুকুও পাইল না। সেই ছয়-সাতটা মহিষে মিলিয়া শিং এবং পায়ের আঘাতে বাঘটাকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া মারিয়া ফেলিল।
কয়েকদিন ধরিয়া একটা বাঘ আমাদের বাড়ির কাছে ভারি দৌরাত্ম আরম্ভ করিয়াছে। রাত্রিতে তাহার ভয়ে আমাদিগকে শশব্যস্ত থাকিতে হয়। কখনো ঘরের আনাচে-কানাচে কোনো ছোটো জন্তুর উপর লাফাইয়া পড়িতেছে, কখনো উঠানের উপর দাঁড়াইয়া ডাক ছাড়িতেছে। সকালে উঠিয়া প্রতিদিনই দেখিতে পাই–এখানে একটা হরিণের মাথা, ওখানে দুটো শুয়োরের দাঁত, কোথাও-বা খানিকটা মহিষের পা। দিনকতক বড়োই ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। বাঘটাকে মারিবার জন্য খুব চেষ্টা হইতে লাগিল। তিরধনুক ও বন্দুক লইয়া সকলে ফিরিতে লাগিলাম, কিন্তু সে এত সতর্কভাবে চলাফেরা করিত যে, কোনোমতেই তাহাকে মারিতে পারা গেল না। একদিন এক ঝোঁপের কাছ দিয়া আমরা যাইতেছি, এমন সময় ঝোঁপের আড়ালে পায়ের শব্দ পাইয়া মনে করিলাম, বোধ হয় বাঘ যাইতেছে। বন্দুক ভরাই ছিল। ঠিক করিয়া হাতে লইয়া ঝোঁপের ভেতর দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে গেলাম; কিন্তু দেখিলাম–বাঘ নয়, একটা গন্ডার। যথা লাভ, আর গন্ডারও বড়ড়া সাধারণ শিকার নয়– গন্ডার গন্ডারই সই। মনু বলিল, খুব আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে এসো, একটু ঘুরে গিয়ে গুলি করতে হবে। আমি দেখিলাম, সেই ঝোঁপের আড়াল থেকে গুলি করাই সুবিধা। আমরা গন্ডারটিকে বেশ দেখিতে পাইতেছি; অথচ সে আমাদিগকে দেখিতে পাইতেছে না। কোনো বিপদের আশঙ্কা নাই, নির্বিঘ্নে গুলি করা যাইবে। মনুকে সে-কথা বলায় সে বলিল, সে কী। তুমি কি জান না যে গন্ডারের চামড়া এত পুরু যে তাতে গুলি বসে না? এখান থেকে ওর শরীরের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে, গুলি করলে সে গুলি ওর গায়ে বসবে না, অথচ বন্দুকের আওয়াজে শিকার পালাবে। গন্ডারকে মারতে হলে ওর নাকের ভেতর দিয়ে গুলি করতে হবে। কাজেই ঘুরে সমুখদিকে না গেলে ওকে মারতে পারা যাবে না। এই বলিয়া মনু আগে আগে চলিল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে গেলাম এবং এমন একটি জায়গায় গিয়া দাঁড়াইলাম, যেখান থেকে গন্ডারের নাকটি বেশ লক্ষ হয়। তখন মনু আমাকে গুলি করিতে বলিল। অত বড়ো একটা জানোয়ার শিকার করিয়া একটু যশলাভ করিবার আশা আমার না হইয়াছিল তা নয়, কিন্তু আমার হাত তখনও খুব সই হয় নাই। বিশেষত অত বড়ো শরীরটার সমস্তই বাদ দিয়া কোথায় নাকের একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র, সেইখানে গুলি করিতে হইবে, কাজেই আমি রাজি হইলাম না। তখন মনু বলিল, তবে বন্দুকটা ঠিক করে দাঁড়াও, যদি গুলি নাকে না লাগে আর আমাদের দিকে রোখ করে আসে, তবে আর রক্ষে থাকবে না। এই বলিয়া সে বন্দুক সই করিল। গন্ডারটা চোখ বুজিয়াছিল, আমাদিগকে দেখিতে পায় নাই। আমরা মনে করিলাম, ভারি সুবিধাই হইয়াছে। গন্ডারটা আমাদের দেখিতে পায় নাই বটে, কিন্তু তাহার শরীরের উপর গোটাকতক পাখি বসিয়াছিল, তাহারা আমাদিগকে দেখিয়া ভারি ডাকাডাকি আরম্ভ করিল। শেষে ডাকাডাকি ছাড়িয়া গন্ডারটার চোখে-মুখে পাখার ঝাঁপটা মারিতে লাগিল। ঝাঁপটা খাইয়া গন্ডারটা তখন চোখ খুলিল। চোখ খুলিয়াই আমাদিগকে দেখিয়া ভোঁ-দৌড়। মনু যদিও ঠিক সেই সময়েই বন্দুকের ঘোড়া টানিয়াছিল, কিন্তু সে-পর্যন্ত পৌঁছিতে-না পৌঁছিতে গন্ডারটা সরিয়া যাওয়ায়, গুলিও লাগিল না, শিকারও পলাইল। বেলা তখন অনেক হইয়াছে, কাজেই সেদিনকার মতো আমাদের বাড়ি ফিরিতে হইল।