সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে সেই খালে অনেক ঘুরিয়া-ফিরিয়া ছিপখানি এক স্থানে গিয়া লাগিল। আমরা সেখানে উপস্থিত হইবামাত্র, পূর্বদিনের সেই বালকটি কোথা হইতে দৌড়িয়া আসিল এবং চিরপরিচিতের ন্যায় আমাকে আসিয়া বলিল, ভাই এসেছ, এই আমাদের বাড়ি! আমি আশ্চর্য হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কেন, আমি যে আসব তুমি কি তা জানতে? সে বলিল, বাবা বলেছিল যে আমি যদি তার কথামতো কাজ করি, তবে আমার খেলবার সাথি করবার জন্য তোমাকে এনে দেবে।
সে যাহাই হউক, নৌকায় বসিয়া আমি মনে করিয়াছিলাম যে ইহারা যেখানে গিয়া নৌকা রাখিবে, আমি সেইখান হইতে চলিয়া যাইব। কিন্তু পরে দেখিলাম এই অচেনা অজানা স্থানে, এই ভয়ংকর সুন্দরবনের মধ্যে ইহারাই আমার একমাত্র আশ্রয়। ইহাদিগের নিকট হইতে পলাইতে চেষ্টা করা বৃথা এবং পলাইয়া যাইবই-বা কোথায়? চারিদিকে হিংস্র জন্তুর ভয়। সেই দিন বিকালেই একটি ঘটনায় আমি প্রাণ হারাইতেছিলাম। বিকালে আমি ও সেই মগ বালকটি বেড়াইতে গিয়াছিলাম। একস্থানে দেখিলাম একরকম বনফুল ফুটিয়া রহিয়াছে, তাহারই একটি লইবার বড়ো ইচ্ছা হইল এবং আমি ধীরে ধীরে জলের কাছে গেলাম। একটি ফুল ধরিবার জন্য যেমন হাত বাড়াইয়াছি, অমনি সেই মগ বালকটি একটা চিৎকার করিয়া উঠিল। আমি সেই চিঙ্কারে চমকিত হইয়া পা পিছলাইয়া জলে পড়িয়া গেলাম, জলের স্রোতে খানিকটা দূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিলাম, কিন্তু উঠিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার হাত-পা একেবারে আড়ষ্ট হইয়া গেল। আমার সেই অবস্থা দেখিয়া আমার সঙ্গী দৌড়াইয়া আসিয়া জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল এবং হাতে ধরিয়া আমাকে টানিয়া তীরে তুলিল।
আমি যখন ফুলটির প্রত্যাশায় জলের কাছে যাইতেছিলাম, তখন জঙ্গলের ভিতর হইতে একটা প্রকান্ড বাঘ ও একটা প্রকান্ড কুমির একই সময় আমাকে লক্ষ করিতেছিল। বাঘ যখন আমাকে ধরিবার জন্য লাফ দেয়, তখন আমার সঙ্গী বালক তাহা দেখিতে পাইয়া চিৎকার করিয়া উঠে এবং আমি ঠিক সেই সময়েই জলের মধ্যে পড়িয়া যাই। এদিকে ঠিক যে-সময় বাঘ লাফ দেয়, কুমিরও সেই সময় আমাকে ধরিতে আসে। কিন্তু ভগবানের কৃপায় পা পিছলাইয়া জলে পড়িয়া যাওয়াতে আমি উভয়ের হাত হইতে রক্ষা পাই। বাঘটা লম্ফ দিয়া কোথায় আমাকে ধরিবে না কুমিরের মুখের মধ্যে পড়িয়া গেল!
মগ বালকটির সহিত অতি অল্পদিনের মধ্যেই আমার খুব ভাব হইয়া গেল। কীসে আমি সুখী হইব, কী করিলে সুন্দরবনের সেই জঙ্গলবাসের কষ্ট আমার দূর হইবে, সে কেবল দিনরাত্রি সেই চেষ্টায় থাকিত। তাহার নাম ছিল মউংনু। আমি তাহাকে মনু বলিয়া ডাকিতাম। মনুর মা-ও আমাকে আপনার ছেলের মতো দেখিতেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবহীন সেই জঙ্গলে যাহাতে আমি মায়ের অভাব না বুঝিতে পারি, তিনি প্রাণপণে সে চেষ্টা করিতেন।
সেই নিষ্ঠুর দস্যুদলের মধ্যে যে এমন দুইটি স্নেহমাখা কোমল হৃদয় আছে, তাহা আমি আগে বুঝিতে পারি নাই। এবং এমন যে থাকিতে পারে, তাহাও বিশ্বাস করিতে পারি নাই। বাস্তবিকই মনু ও তাহার মায়ের যত্ন, আদর স্নেহ ও ভালোবাসায় আমি কোনো কষ্ট বা অভাবই বোধ করিতাম না। বাড়ির জন্য প্রথম প্রথম যে কষ্ট হইত, তাহাও যেন ক্রমে ভুলিয়া যাইতে লাগিলাম।
মনু ছায়ার মতো সর্বদাই আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে; আমরা একত্রে খাই, একত্রে শয়ন করি, একত্রে বেড়াইতে যাই। মনুর বুদ্ধি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল এবং সে আমার সমবয়স্ক ছিল। আমার বয়স তখন তেরো বৎসর। ইংরেজিতে আমি যে-সকল বাঘ-ভালুকের গল্প পড়িয়াছিলাম, মনুকে তাহা বলিতাম, তাহা ছাড়া, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প তাহাকে শুনাইতাম। খেলা করা, গল্প করা এবং ক্ষুধার সময় খাওয়া ভিন্ন আমাদের আর কোনো কাজ ছিল না। মনুও সন্দুরবনের বাঘ-ভালুকের অনেক গল্প আমাকে শুনাইত। কিন্তু রামায়ণ মহাভারতের গল্প তাহার কাছে সম্পূর্ণ নতুন ছিল। সে খুব আগ্রহের সহিত সেই সকল গল্প শুনিত। ক্রমে তাহার সেই সকল পড়িবার একটা আগ্রহ জন্মিল। আমারও ইচ্ছা হইল, তাহাকে লিখিতে-পড়িতে শিখাই।
মনু একদিন তাহার বাবাকে গিয়া বলিল, আমাকে বই এনে দাও, আমি লেখাপড়া শিখব। মনুর বাবা তাহার কথা শুনিয়া হাসিয়া উঠিল এবং বলিল– বাঙালির ছেলেটা দেখছি তোকে একেবারে বাঙালি করে তুলেছে! লেখাপড়া শিখে তুই কি পন্ডিতি রকমে ডাকাতি করবি নাকি? লেখাপড়া শিখলে তুই কি আর মানুষ থাকবি, ওই বাঙালির ছেলেদের মতো ভীরু হয়ে যাবি, জুজু হয়ে থাকবি। কলম বাঙালির ছেলের অস্ত্র, আমাদের অস্ত্র তিরধনুক, তলোয়ার-বন্দুক। বাঙালির অস্ত্র কলমে বাঘ-ভালুকও শিকার করা যায় না, ডাকাতিও চলে না। যে-বিদ্যে তোর কাজে লাগবে তুই তাই শেখ, অন্য বিদ্যে শিখে তোর দরকার নেই। মনু ছাড়িবার পাত্র নয়। সে বলিল, তুমি জান না তাই ও-কথা বলছ, বইয়ে যে-সকল বীর পুরুষদিগের কথা লেখা আছে, যে-সকল যুদ্ধের কথা লেখা আছে, তা শুনেই আমার শরীর গরম হয়ে ওঠে, সেসব যদি নিজে পড়তে পারি, তবে তাতে আমার সাহস আরও বেড়ে যাবে। তোমরা ডাকাতি করো লুঠপাট করো, আমি রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, আর তাদের হারিয়ে দিয়ে রাজা হব। কথাগুলি বলিবার সময় যেন মনুর শরীর উৎসাহে স্ফীত হইয়া উঠিয়াছিল। চক্ষু দিয়া যেন একটা তেজ বাহির হইতেছিল। মনুর বাবা তাহার কথায় একটু অবাক হইয়া গেল। আর কোনো কথা না বলিয়া তাহাকে বিদায় করিল।