কতক্ষণ চেতনাশূন্য হইয়া পড়িয়াছিলাম জানি না, যখন চেতনা হইল, তখন ধীরে ধীরে চাহিলাম। চাহিয়া দেখিলাম, আমাদের সে বজরাও নাই, সঙ্গের লোকজনও নাই। একখানি খোলা নৌকার উপর আমি শুইয়া রহিয়াছি। রাত্রি তখন প্রভাত হইয়াছে। আমি ধীরে ধীরে নৌকার উপরে উঠিয়া বসিলাম। উঠিয়া দেখি, একটা খালের মধ্য দিয়া নৌকাখানি যাইতেছে। সেখানি ছিপ নৌকা। ছিপটি বহিতেছিল আট-দশজন খুব বলিষ্ঠকায় লোক। কাজেই ছিপখানি তিরবেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। রাত্রি প্রভাত হইয়াছিল বটে, কিন্তু সেই খালের দুই কূলে এত ঘন জঙ্গল যে সূর্যের কিরণও তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। আমি সেই অল্প আলোকে যাহা দেখিলাম, তাহাতেই বুঝিতে পারিলাম যে, ইহারা গত রাত্রের সেই আরাকানি দস্যুদল। আমাদের বজরা লুঠপাট করিয়া ইহারা আমাকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে। আমি উঠিয়া বসিবামাত্র পশ্চাৎ দিক হইতে কে একজন বলিয়া উঠিল, কী গো বাবু, ঘুম ভাঙল? সেই কথায় ফিরিয়া চাহিয়া আমি দেখিলাম, যে-লোকটি মেলায় আমাদের সঙ্গ লইয়াছিল– এ সে-ই! তখন আমি সব বুঝিতে পারিলাম। মেলায় আমার চলাফেরা ভাবগতিক দেখিয়া সকলেই মনে করিয়াছিল যে, আমরা খুবই বড়োলোক। এ লোকটাও তাহাই মনে করিয়া আমাদের সঙ্গ লইয়াছিল এবং দূরে দূরে থাকিয়া খোঁজখবর লইতেছিল। পরদিন যে মগ বালকটি আমার সঙ্গে ফিরিতেছিল এবং যাহাকে শেষে আমি ইহার সঙ্গে কথা কহিতে দেখিয়াছিলাম, সেও বোধ হয় ইহাদেরই লোক এবং বোধ হয় ওই উদ্দেশ্যেই আমার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দিন ফিরিতেছিল। তখন সেই মগ বালকটির সঙ্গে অত ভাব করিয়াছিলাম বলিয়া মনে অনুতাপ হইল।
সেই লোকটার কথায় কোনো উত্তর না দিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমাদের বজরা কোথায়, আমাদের লোকজন কোথায়, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? যাব না আমি তোমাদের সঙ্গে, তোমরা আমাকে আমার সঙ্গীদের কাছে দিয়ে এসো। এই কথা শুনিয়া ছিপের লোকগুলি সকলেই একসঙ্গে বিকট রবে হাসিয়া উঠিল। সে-হাসিতে আমি চমকিয়া উঠিলাম। তোমরা হয়তো মনে করিতেছ, হাসির রবে আবার চমকায় কে? কিন্তু তোমরা নিশ্চয় তেমন বিকট হাসি শুনো নাই, তাই ও-কথা মনে করিতেছ। আমি তো বালক মাত্র, একটা হিংস্র জন্তু পর্যন্ত সে-হাসির রবে ভয় পাইয়াছিল। হঠাৎ সেই সময় তীরের দিকে চোখ পড়ায় আমি দেখিলাম, তীরের কাছে জঙ্গলের মধ্যে একটা চিতাবাঘ বোধ হয় মাছ ধরিতেছিল, হঠাৎ সেই বিকট হাসির রবে চমকিয়া উঠিয়া সে দৌড় দিল।
যাহা হউক, লোকটা আমাকে বলিল, তোমাদের বজরা এবং লোকজন এতক্ষণ জলের নীচে বিশ্রাম করছে। সেখানে যাওয়ার চেয়ে, বোধ হয় আমাদের সঙ্গে যাওয়া মন্দ নয়। আর কে-ই বা তোমাকে সেখানে দিয়ে আসতে যাবে, কী বল? বুঝিলাম, ডাকাতেরা আমাদের সঙ্গের লোকজনকে হত্যা করিয়া বজরা সমেত সমুদ্র-জলে ডুবাইয়া দিয়াছে।
প্রথম প্রথম আমার মনে খুব ভয় হইয়াছিল বটে, কিন্তু যখন শুনিলাম যে ডাকাতেরা আমাদের বজরা ডুবাইয়া দিয়াছে, লোকজনদিগকেও হত্যা করিয়া ফেলিয়াছে এবং যখন দেখিলাম যে, আমি সম্পূর্ণরূপে ইহাদের হাতেই পড়িয়াছি, তখন আমার ভয় একেবারে চলিয়া গেল। বিপদে পড়িবার ভয়েই লোকে ভয় পায়। কিন্তু বিপদের মধ্যে পড়িলে তখন আর সে ভয় থাকে না। আমারও তাহাই হইল। আমি রাগিয়া উঠিয়া বলিলাম, জলে ডুবে মরতে হয় সেও ভালো, তবু আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না; চোর-ডাকাতের সঙ্গে একত্রে থাকার চেয়ে মরাও ভালো। নামিয়ে দাও তোমরা আমাকে এইখানেই।
লোকটি আবার তেমনি বিকট করিয়া হাসিয়া উঠিল এবং অন্যেরাও তাহার হাসিতে যোগ দিল। বলিল, কোথায় নামবে এখানে? এ যে সুন্দরবন! এখানে জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, সে-কথা কি জান না? বিশ্বাস না হয়, ওই দেখো–এই বলিয়া সে কূলের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল। আমি চাহিয়া দেখিলাম একটা বাঘ খালের তীরে আসিয়া জলপান করিতেছে। তখন ভাবিলাম, কথা তো মিথ্যা নয়। আমাকে ডাকাতেরা সুন্দরবনের মধ্যে লইয়া আসিয়াছে, এখানে এই ভয়ংকর স্থানে কোথায় গিয়া আমি দাঁড়াইব? বুঝিলাম ইহাদের সঙ্গে জোর করিয়া লাভ নাই। বাধ্য হইয়াই আমাকে ইহাদের প্রস্তাবে রাজি হইতে হইল, সুতরাং, আমি আর কোনো কথা কহিলাম না। নীরবে সহিয়া নিজের অদৃষ্ট চিন্তা করিতে লাগিলাম। সেই ছিপের উপর বসিয়া বসিয়া বাড়ির কথা, দাদামহাশয়ের কথা, মা-বাবার কথা, ভাই বোনের কথা–সমস্ত একে একে মনে উঠিতে লাগিল। তখন একবার মনে হইয়াছিল, কেন সকলের অবাধ্য হইয়া গঙ্গাসাগরে আসিয়াছিলাম? এই ঘটনার মূলই আমি। আমার জন্যই এতগুলি লোক ডাকাতের হাতে প্রাণ হারাইল। আমার চলাফেরা ভাবগতিক দেখিয়াই তো ডাকাতেরা ঠাহর পাইয়াছিল; আমি না আসিলে তাহারা কোনো সন্ধানই পাইত না। দাদামহাশয় সমস্ত রাত্রি কপিল মুনির মন্দিরে ছিলেন, ভোর বেলা নদীতীরে আসিয়া বজরা দেখিতে না পাইয়া তিনিই বা কী করিতেছেন? ডাকাতেরা সকলকে হত্যা করিল, আমাকে কেন হত্যা করিল না এবং কেনই-বা আমাকে তাহারা লইয়া আসিল? এই সকল নানা চিন্তায় আমি একেবারে ডুবিয়া গেলাম। সেই সময় হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। সেই লোকটা বলিল, ওই শুনছ, এখানে নামবে? ওই চেয়ে দেখো! আমি কূলের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একটা প্রকান্ড বাঘ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, বুঝিলাম সে বিকট রব আর কিছু নয়, এই বাঘেরই ডাক।