বদরুদ্দিন মাঝি আসিল!
দাদু বলিলেন–কী দাদু, চললে সত্যি?
আপনি যা বলেন।
যাও, দেশ থেকে ঘুরে এসো।
ঠিক আসব।
আমার শিষ্য করে নেব তোমাকে।
আমি শুধু আপনার এখানে থাকতে চাই।
আমার কি অনিচ্ছে? দেশে অনেকদিন যাওনি, ঘুরে এসো।
যাইবার আগের দিন সন্ধ্যার সময় দাদু আমাকে সমুদ্রের ধারে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, দাদু সাবধানে থেকো। আবার এসো। একটা কথা–
কী?
কী নেবে বলো?
কী নেব?
যা ইচ্ছে, মুক্তো নিয়ে যাও।
একথা ভেবে বলব।
ভাবার কী আছে এর মধ্যে?
আপনার শিষ্য কি বৃথা হয়েছি? ভেবে দেখব, তবে বলব।
একা একা বিস্তীর্ণ বালুতটে দাঁড়াইয়া কত কী ভাবিলাম। দাদুর মুক্তা লইব। দাদু কিছুই বলিবেন না জানি, যত খুশি লইতে পারি বটে, কিন্তু বেশি টাকা হাতে পাইলে আমি শান্তি পাইব না। তবে দাদুর স্নেহের উপহারস্বরূপ, তাঁহার মলিন স্মৃতির চিহ্ন হিসেবে একটি মাত্র মুক্তা তাঁহার হাত হইতে গ্রহণ করিব।
দাদু পরদিন বলিলেন– কী নেবে?
কিছুই না, কেবল একটা মুক্তো নেব আপনার হাত থেকে।
খুব বিস্মিত হলাম। তুমি ছেলেমানুষ, এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সোজা কথা নয়। অনেক বড়ো বড়ো লোক পারে না। আশীর্বাদ করি, মানুষ হও।
মানুষ হও মানে বড়োলোক হও না তো?
টাকার বড়োলোক না,–এসো—
দাদা একটা পুঁটুলি খুলিয়া একটি মুক্তা আমার হাতে দিলেন। পুঁটুলিটি ঘরের এক কোণে অযত্নে পড়িয়াছিল। মুক্তাটি কখনো দেখি নাই, দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। বলিলাম–এ দিলেন কেন?
দাদু স্নেহবিগলিত কণ্ঠে বলিলেন–আমার সাধ এটা। নিয়ে যাও—
বদরুদ্দিনের নৌকাতে উঠিবার সময় তাঁহার পায়ের ধুলা লইয়া মাথায় দিলাম। তাঁহার চোখে জলের মতো ও কী চিকচিক করিতেছে। অনেক দূর হইতে দেখি, তিনি ছবির মতো সমুদ্রবেলায় দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে আমাদের নৌকার দিকে চাহিয়া আছেন।
.
বাড়ি ফিরিয়া যাহা শুনিলাম তাহাতে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। মা নাই, দাদামহাশয় আছেন বটে, কিন্তু একেবারে শয্যাশায়ী, শরীর জীর্ণ-শীর্ণ, অস্থিকঙ্কালসার। আমাকে হারাইয়া দারুণ দুঃখে মৃতপ্রায়।
এই দীর্ঘ সাত বৎসরে আমার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হইয়াছিল, তবু দেখিবামাত্র কষ্টে গাত্রোত্থান করিয়া দাদু রে আমার বলিয়া দাদামহাশয় আমাকে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, আমার প্রত্যাগমনের পর হইতে তিনি ক্রমশ সুস্থ হইয়া উঠিলেন, হাতে পায়ে বল পাইলেন।
একদিন তাঁহাকে প্রথম হইতে আমার সমস্ত ঘটনা বসিয়া বসিয়া বলিলাম! দাদুর কথা শুনিয়া দাদামহাশয় দু-হাত জোড় করিয়া বার বার তাঁহার উদ্দেশ্যে প্রণাম করিলেন।
বলিলাম–দাঁড়ান, একটা জিনিস দেখাই।
পরে মুক্তাটি বাহির করিয়া তাঁহার হাতে দিলাম। দাদামহাশয় বৈষয়িক ব্যক্তি, মুক্তা চিনিতেন। বিস্ময়ে তাঁহার চোখ বড়ো বড়ো হইয়া উঠিল। বলিলেন–এ কী, কে দিলেন, তিনি?
হ্যাঁ।
এর দাম কত তোমার আন্দাজ হয়?
জানি নে।
অন্তত বিশ হাজার টাকা। এ নিয়ে একটা ব্যাবসা করো দাদু। আমি সব ঠিক করে দেবো।
আপনি যা বলেন।
সত্যি বড়োলোকের দেখা পেয়েছিলে!
দাদামহাশয়কে ছাড়িয়া যাইতে পারিলাম না কোথাও। তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া মায়া হইত। আমাকে পুনরায় হারাইলে বৃদ্ধ এবার আর বাঁচিবেন না।
ব্যাবসা করিতেছি, উন্নতিও হইয়াছে। বৎসর খানেক কাটিয়াছে। নির্জন দ্বীপের আমার সেই দাদুকে কখনো ভুলি নাই, তাঁহার সেই ছবির মতো মূর্তিটি মনের পটে চিরদিন অক্ষয় হইয়া থাকিবে। জানি না আবার কবে দেখা হইবে!
মাঝে মাঝে রাত্রে স্বপ্নের মধ্যে দেখি তিনি বলিতেছেন–দাদু, মানুষ হও, সময় কখনো নষ্ট কোরো না–কথাটা ছোটো, কিন্তু মস্ত বড়ড়া উপদেশ জীবনের পক্ষে।
স্বপ্নের মধ্যেই বলি–আপনি আশীর্বাদ করুন।
সেই সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপটি, সেই নীল জলরাশি, সেই চিত-করানো কচ্ছপগুলো আবার যেন চোখের সামনে তখন ফুটিয়া উঠে।